শিরোণাম পড়েই হয়ত বুঝে নিয়েছেন সাম্প্রতিক আলোচিত , নন্দিত (সামান্যই) এবং নিন্দিত লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার অনুষ্ঠান্টি নিয়ে আরো একটি লেবু কচলানো হতে যাচ্ছে । নাহ, এখনই বিরক্ত হয়ে ফিরে যাবেন না । মেয়েদের শরীর প্রদর্শন , বাঙ্গালীত্ব , ধর্ম তত্ত্ব - এই সব কচলানো লেবু নিয়ে তিতা করার কোন ইচ্ছা আমার নাই । আমি বরং আমার ফিল্ডের কাছাকাছি মেডিকেল ও বৈজ্ঞানিক কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই । আর যেই বিষয়টায় আমার চিরকালীন এলার্জি আছে , সেই মেগা কর্পোরেট দুনিয়া কি ভাবে আমাদের মন, মেধা , মনন ও স্বাভাবিক বুদ্ধি বিবেচনা খেয়ে ফেলছে , তাই নিয়ে দু'চারটা কথা বলতে চাই ।
নিঃসন্দেহে সৌন্দর্য চর্চা একটা ব্যবসা । ট্রিলিওন ট্রিলিওন ডলারের ব্যবসা । এই ব্যবসার মূলে আছে মূলত কর্পোরেট পুঁজিবাদ । পুঁজিবাদ কি বলে? পুঁজিবাদ বলে প্রোডাকশন বা উৎপাদনের সব রকমের উপাদান , মালামাল বা সার্ভিস, বিক্রি ও লাভ - সব কিছুর মালিক হবে ব্যক্তি । উৎপাদন প্রক্রিয়ার লেন দেন হবে মার্কেটে এবং বেতন ও দাম নির্ধারন করবে মার্কেট । কর্পোরেট পুঁজিবাদ বলা হয় সাধারণত ঐ ধরনের ব্যবস্থাকে যেইখানে , আইন অনুযায়ী কর্পোরেশন বা সংস্থাকে হতে হবে প্রফিট ওরিয়েন্টেড । অর্থাৎ , একটা হাঁচি কাশি দিতে গেলেও সেইখানে আপনার লাভ থাকতে হবে । অর্থনীতির ড্রাইভার সমূহ একটি এবং একটি মাত্র লক্ষ্য নিয়ে আগাবে তা হলো " প্রফিট বা লাভ" ।
কমিউনিজম বা সোসালিজম এর সাথে এর মূল পার্থক্যটা হলো , কমুইনিটি বা সোসাইটির সার্বিক লাভালাভ এইখানে বিবেচ্য থাকে না । বিবেচ্য থাকে কর্পোরেট এর লাভ। মালিক যেহেতু ব্যক্তি তাই ব্যক্তিগত লাভ। তাতে সমস্যাটা কি ?
সমস্যাটা হলো , আপনাকে যখন পুরো কমিউনিটি বা সোসাইটির লাভ মাথায় রেখে লেন দেন করতে হবে , তখন আপনি এই কমিউনিটি বা সোসাইটির কোন সদস্যের কোন ক্ষতি হয় , এমন কোন লেন দেন বা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না । সুতরাং, আপনাকে এথিকাল ট্রেডিং করতে হবে । এখন একটা রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হয় , তাহলে সে তার জনগণের কাছে একাউন্টেবল এবং জনগণের জন্য অনিষ্ট করে এমন কোন সিদ্ধান্ত , ব্যবসা করতে পারবে না । দুনিয়ার কর্পোরেট গুলা যতদিন রাষ্ট্রের অধীনে ছিলো , তারাও এই নৈতিকতা মেনে চলতে বাধ্য ছিলো । কিন্তু এখন মাল্টীন্যাশনাল কোম্পানি গুলা ধনে, সম্পদে , পলিটিকাল পাওয়ারে যে কোন একটি রাষ্ট্রের অধীনে নয় । আগে রাষ্ট্র কর্পোরেটকে নিয়ন্ত্রন করত। এখন কর্পোরেটই উলটা রাষ্ট্রকে চালায় । সুতরাং , ভোটের মাধ্যমে কে নির্বাচিত হবে , সেইটাও আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। মূলত পৃথিবীর সমস্ত ধন সম্পদ, পলিটিকাল ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রন চলে গেছে জনগণ তথা রাষ্ট্রের বাইরে , কতগুলা মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেটের হাতে । ন্যায়, নীতি , উচিত , অনুচিত বলে তাই আর দুনিয়াতে কিছু নাই । সবই প্রফিট ওরিয়েন্টেড । দুনিয়া জুড়ে যেই তথা কথিত এন জি ও , ডেভেলপমেন্ট, ডোনার , হেলথ , ডেভেলপমেন্ট এইড ইত্যাদি ইত্যাদি গাল ভরা নাম আর কার্যক্রম চলে , এইটাও আসলে কর্পোরেট বাণিজ্যেরই আরেকটা রুপ । নামেই নন প্রফিট , আসলে বিজনেস।
বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে ? কল্পনা করুন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে । এদের কত্তগুলা হাত আছে ?
ক। নন আর্মস , লিগাল ব্যবসার হাত
১। পলিটিকাল দল বা রাজনৈতিক ব্যবসার হাত
২। সম্পূর্ণ ফর প্রফিট ব্যবসার হাত - যেমন কম্পিউটার, ব্যাংক , প্রকাশনা
৩। প্রফিট - নন প্রফিট মিক্স সেবা খাত হিসেবে ধরা হয় এমন ব্যবসা - হাস্পাতাল, ইউনিভার্সিটি
৪। সম্পূর্ণ নন প্রফিট ( আসলে প্রফিট) ব্যবসা - এন জি ও
খ। আর্মড ও ইলিগাল ব্যবসার হাত
১। অস্ত্র চোরাচালান ও বিক্রি
২। মাদক এবং অন্যান্য অবৈধ পণ্যের বেচাবিক্রি
৩। আদম পাচার ইত্যাদি
এখন একটু চিন্তা করে দেখেন , এই সব কয়টা হাত মিলিয়ে জামায়াত কিন্তু বাংলাদেশের একেবারে গরীবের চেয়ে গরীব এবং উপরের ধনীর চেয়ে ধনী সব কয়টা স্তরেই ব্যবসা করছে । ক্ষুদ্র ঋণ থেকে শুরু করে ভার্সিটি, ব্যাংকিং, হাসপাতাল , তার উপরে ধর্ম ও পলিটিক্স । তার মানে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ হইলাম আমরা জামায়াতের ক্রেতা গোষ্ঠী এবং আমাদের শ্রম ও শ্রমের পয়সা চলে যাচ্ছে তাদের পকেটে । তাই রাজনৈতিক গ্রহনযোগ্যতা না থাকলেও জামায়াত গেড়ে বসেছে আমাদের গলার কাঁটা হয়ে , এবং এইটা ঘটেছে গত ৩০ বছরে । ঠিক এই ভাবেই কল্পনা করুন, বিশ্বের কয়েকটা মাত্র কোম্পানি এক এক করে কিনে নিচ্ছে অর্থনীতির সব কয়টা হাত । কি ঘটবে?
সারা বিশ্বই তখন পরিণত হবে একটা বাজারে যেইখানে সকলেই ক্রেতা বা কঞ্জিউমার । যে যত বড় বা বেশি কনজিউমার , তার দাম তত বেশি। আর সকল কার্যক্রমের মূলে রয়েছে শুধুই লাভ আর লাভ। লাভ নাই তো সব বন্ধ। এর ভিতরে লাক্সের চামড়া আসল কই থেকে , এইটাই ভাবছেন তো ?
পড়ুন২য় পর্ব ।
প্রথম পর্ব থেকে দুইটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ।
১। কর্পোরেট পুঁজিবাদ চালিত হয় একমাত্র লাভ বা প্রফিটের দ্বারা , এইখানে নিয়ম নীতি , উচিত -অনুচিত , এথিকাল - নন এথিকালের বালাই নাই
২। এই মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেট গুলো অর্থনীতির লিগাল, ইলিগাল, সোসাল - সব কয়টা হাত কিনে নিয়ে নিয়ন্ত্রন করছে ।
অর্থাৎ , যেই কোম্পানি মানুষের পয়সা চুষে খেয়ে ফুলে ফেপে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে , সেই আবার কর্পোরেট সোসাল রেস্পন্সিবিলিটির নামে সোসাল ওয়ার্ক করে বেড়াচ্ছে ।
মানে , ধরুন আপনার কাছে একটা গরু আছে । ঐটা দিয়ে আপনি দুধ উৎপাদন করতেন , নিজে খাইতেন , পরিবারকে খাওয়াইতেন আর বাড়তিটুকু বিক্রি করে সংসার চালাইতেন। এখন আমি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আপনার কাছ থেকে অনেক টাকায় গরুটা কিনে নিলাম । এবং দুধ আপনার কাছে বিক্রি করা শুরু করলাম , আপনিও কিনতে বাধ্য কারন আপনার নিজের আর গরু নাই। আপনি টাকার লোভে গরু বিক্রি করে দিলেও কিছু দিন পরেই ভুলটা বুঝলেন, টাকা তো চিরদিন থাকে না, খরচ হয়ে যাচ্ছে , কিন্তু তখন আর কিছু করার নাই । আপনার পয়সা ফুরায় গেলে আমার কাছেই হাত পাতলেন । আমি আপনাকে আমার মালিকানাধীন গরু যেইটা আগে আপনার ছিলো সেইটা দেখা শোনার দায়িত্ব দিলাম এমন বেতনে যেইটা দিয়ে বাচ্চা কাচ্চা দূরে থাক , আপনার নিজেরই এক গ্লাস দুধ জুটে না । এইবার আমি আমার কর্পোরেট সোসাল রেস্পন্সিবিলিটির নামে আপনারে দুধ কিনার ঋণ দিলাম। সেইটা দিয়ে আপনি নিজের বাচ্চার জন্য দুধ কেনা শুরু করলেন। আপনাকে বিক্রির কমিশন দেওয়ার লোভ দেখালাম ও ক্রেতা বাড়াতে বললাম। অচিরেই আপনি বুঝতে পারলেন , আয় না বাড়ালে ঋণ শোধ করা যাচ্ছে না । বাচ্চার লেখা পড়া বন্ধ হয়ে গেছে । আর আশে পাশের বাড়িতে যতদিন দুধ আলা গাভী থাকবে , আপনার বিক্রি বাড়বে না । আমাকে আর কিছু করতে হইলো না । বাঁচার তাগিদে আপনি আশে পাশে লোকজনকে গাভী বিক্রির জন্য মূলামূলি শুরু করলেন। ইতমধ্যে আমার লাভের টাকা দিয়ে আমি একটি স্কুল খুললাম । আমার কাছ থেকে স্বল্পসুদে ঋণ নিয়ে সেইখানে বাচ্চা কাচ্চারে পড়াতে শুরু করলেন। সেইখানে আমি তাদের আমার সুবিধা মত উচিত, অনুচিত, ভ্যালু শিক্ষা দিলাম । কিন্তু দিনে দিনে খরচ বেড়েই চলেছে , শেষে ভিটা মাটি বন্ধক পড়লো আমার কাছে । স্বভাবতই , আমি মহান । তাই আপনার বউকে নিয়ে এলাম , ট্রেনিং দিলাম ও একটা মিষ্টির কারখানা বানিয়ে তাতে কাজে লাগালাম। আগে ২২ টাকা লিটারের দুধ আমি নিতাম ২০ টাকা । আপনার বেতন ছিল ২ টাকা । মিষ্টির কারখানায় দুধ বেচে এখন পান ৪ টাকা (কমিশন সহ) । বউ এর বেতন ২ টাকা ( যেহেতু মেয়ে) । মিষ্টির কেজি ১৪০ টাকার ১৩৬ টাকা আমার । ভুলে যাবেন না , আপনার ৬ টাকা থেকে আমাকে কিস্তি দিতে হয় কিন্তু । ধরে নেই , কিস্তি ২ টাকা । সেখান থেকে আমি রাখি ১ টাকা । বাকি ১ টাকা দেই আপনার ছেলেকে যে মাসে মাসে কিস্তির টাকা আমাকে এনে দেওয়ার কাজ নিয়েছে আমি যেই নতুন ব্যাংকটা খুলেছি সেইখানে। ইতমধ্যে আপনার মেয়ে স্কুল পাশ দিয়েছে । আমি তাকে ট্রেনিং দিয়ে পোল্ট্রির কাজে লাগিয়েছি যেইটা আপনার আগের ভিটায়/ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত । শিক্ষিত বলে তার বেতন আড়াই টাকা । চাইলে অবশ্য সে ঋণ নিয়ে আমার পোল্ট্রির মুরগীগুলাকে বেচার ব্যবসা করতেই পারে। এই রকম ভয়ানক পরিশ্রমের ফলে অসুখ বিসুখ হইতেই পারে । তাই আমি একটা হাসপাতাল দিয়েছি । সংস্থার কর্মী হিসেবে ঐখানে আপনি ৩০% ডিস্কাউন্টে চিকিৎসা পান। এর ভিতরে এলাকায় ইলেক্ট্রিসিটি নিয়ে এসেছি। আমার নতুন গার্মেন্টস আর বিড়ি সিগারেটের কারখানাইয় আপনার আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শীরা কাজ করে , যাদের গরু গুলোকে আপনিই তাদের প্রলব্ধ করেছিলেন আমার কাছে বেঁচে দিতে । এরাই আবার আমার মিষ্টি, কাপড় , বিড়ি, শিক্ষা , চিকিৎসা ইত্যাদির ক্রেতাও ।
এই গল্পটা থেকে ৩টা জিনিস শিখবেন ।
১। আপনার বেতন যতই বাড়ুক, আপনি কোনদিনই আমার মতন বড়লোক হইতে পারবেন না , আর ১৪ জেনারেশন ধরে চেষ্টা করেও পুরাপুরি ঋণ মুক্ত হইতে পারবেন না । শুভংকরের ফাঁকিটা ঐখানেই ।
২। আপনার বেতন আমি তখনই বাড়াব যখন আমার উৎপাদিত পণ্যের ক্রেতা বাড়ানোর জন্য একটা নির্দিষ্ট ক্রয় ক্ষমতা সম্পন্ন কনজিউমার বাজার লাগবে ।
৩। আগে আপনি ও আপনার আশে পাশের সবাই গরু নামক একটি উৎপাদক যন্ত্রের মালিক ছিলো । আজকে আমি হইলাম মালিক আর আপনারা সবাই আমার ইচ্ছার অধীন , উচ্চ বেতন সম্পন্ন , মাল্টিন্যাশনালে কর্মরত গর্বিত কর্মী । পাশাপাশি আমার ক্রেতা।আপনে যতই উপরে উঠেন, আমি মালিক, আপনি আমার চাকুরে/চাকর
এর নাম কর্পোরেট বাণিজ্য । আমি আপনাকে প্রতি পদে পদে ঠকাচ্ছি , ঠকিয়ে নিজে লাভ করছি । প্রথমে ঠকাচ্ছি বেশি দামে গরু বিক্রির লোভ দেখিয়ে ( অনেক বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন) , তারপর বেতনে , তারপর ঋণে , তারপর সুদে , তারপর ডিস্কাউন্ট দেওয়ার নামে উৎপাদিত পণ্যের বান্ধা কাস্টমার বানিয়ে , এবং পরিশেষে আপনাকে চিরদিনের জন্য ঋণে বেধে ফেলে ।
আপনার গরু , আপনার গরুর দুধ এখন একবার দুয়ানোর জন্য শ্রম দিবেন, তারপর কেনার জন্য শ্রম দেবেন , তারপর বেঁচার জন্য শ্রম দিবেন । সুতরাং, কইয়ের তেলে কইই শুধু ভাঁজছি না আমি , একটা মাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাঝে আমি আপনাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধাপে শোষন ও করছি ।
শুরুতে এই কর্পোরেট নামক শোষক যন্ত্রটি ছোটই থাকে । আস্তে আস্তে এরা গ্রাস করে নেয় খাদ্য , বস্ত্র, বাসস্থান , শিক্ষা , চিকিৎসা, বিনোদনের মত মৌল চাহিদা মেটানোর সব কয়টা উৎপাদনের উপকরণ ।
এখন এই গ্রাস তারা কেমনে সম্ভব করে? কিছু দিন আগেও প্রধান তরিকা ছিলো যুদ্ধের মাধ্যমে দখল ও সরাসরি শোষণ। যেমন, বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত শাসন। কিন্তু এতে দেখা গেলো দুই দিন পর পর, খালি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে দেয় ফাউল পোলাপাইন । এইবার নতুন তরিকা । সেই ম্যাট্রিক্স ছবিটার মতন সবাইরে ঘুম পাড়ায় রাখো । তুমি মনে করবা তুমি স্বাধীন , বাস্তবে স্বাধীন না । ঠিক এই কাজটাই এখনকার মাল্টিন্যাশনাল বিজনেস ওয়ার্ল্ড করে থাকে যার নাম মার্কেটিং ( আসলে ব্রেইন ওয়াশিং) । তা মার্কেটিং কাকে বলে ?
মার্কেটিং হলো সেই প্রক্রিয়া যা আপনাকে কিনতে বাধ্য করবে এমন একটা বস্তু যা আপনার কোন কালেই দরকার ছিলো না এবং অবশ্যই উৎপাদনের দশগুণ দামে ।
এখন এই মার্কেটিং এর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হইলো মিডিয়া । ২৪ ঘন্টা যেই মিডিয়া আমাদেরকে কিছু ভ্যালু বা মূল্যবোধ শিক্ষা দেয় । আপনারা হয়ত ভাবতে পারেন আপনার উপরে মিডিয়ার কোন প্রভাব নেই । কিন্তু মাথা ঠান্ডা করে খুব সূক্ষ ভাবে চিন্তা করলেই দেখবেন , আজকের মিডিয়া আমাদেরকে কি দেয়? তথ্য ? বিনোদন ? নাকি শিক্ষা ?
কোনটাই না ।
মিডিয়া আমাদেরকে দেয় অর্থ বা মিনিং । প্রতিটা মানুষেরই মূল তিনটা প্রশ্ন থাকে , আমি কে , আমি কি এবং আমি কেন ? আমরা বেশির ভাগই হন্যে হয়ে এই প্রশ্ন গুলার উত্তর খুঁজে বেড়াই আর মাল্টি কর্পোরেশনের মার্কেটিং বিভাগ ঠিক এই উত্তর গুলাই তাদের সুবিধামত আমাদের সামনে হাজির করে । লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতা এই কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের বাণিজ্যের সাথে এই ভাবেই জড়িত । তারা প্রতিনিয়ত ঠিক করে দিচ্ছে , বাংলাদেশের একজন নারী কে? কি এবং কেন ?
লাক্সের বিজ্ঞাপন অনুযায়ী ,
কে? - আমি একজন সুপারস্টার
কি? - অন্যদের চেয়ে অনেক অনেক উপরে, অনেক বেটার
কেন? - কারন আমি বিশেষ একটি ইমেজ যাপন করি
লক্ষ্য করে দেখুন, একটা মানুষের আত্মপরিচয়, অস্তিত্বের মাপ কাঠি এবং জীবন যাপনের উদ্দেশ্য বিধেয় লাক্স ঠিক করে দিচ্ছে । লাক্স আমাদের ব্রেইন ওয়াশ করে এইটা প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে যে একটি নির্দিষ্ট চেহারা , নির্দিষ্ট কিছু স্কিল (নাচ, ক্যাট ওয়াক, শপিং , দেহের মাপ ধরে রাখা ইত্যাদি) আমাদেরকে মানুষ হিসেবে অন্যদের চেয়ে বেশি দামী করে তুলবে । এবং আমরা তখন সুপারস্টার হয়ে যাব । আর সুপার স্টার হলেই আমরা মানুষের ভালোবাসা , সম্মান, প্রতিষ্ঠা , সাফল্য পাব। সেই সাফল্যের সংজ্ঞা , সেই ভালোবাসা পাওয়ার তরিকা বাতলে দিতে পারে কেবল লাক্স আর চ্যানেল আই।
আমাদের , বাংলাদেশের ২০০০ বছরের সংস্কৃতি , প্রাচ্যের দর্শন , জীবন বোধ কি বলে? আমরা কি সাফল্যের এই সংজ্ঞায় অভ্যস্ত? আমাদের হাজার বছরের জীবন ভাবনা আমাদের এতদিন শিখিয়েছে ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। মাত্র দুটি কাপড়েই জীবন ভালো ভাবে চলে যেতে পারে। অল্প খাও কিন্তু খাঁটি খাও । কিছুদিন আগে পর্যন্তও বেশি শুকনা মেয়েদের বিয়ের সমস্যা হইত কারন আমরা একটু স্বাস্থ্যবতী বউ পছন্দ করতাম। সৌন্দর্য্যের মাপ ছিল সাদামাটা টানা টানা কাজল কালো চোখ আর খোঁপায় বেলী ফুলের মালা। টিভি মিডিয়ার বদৌলতে আমরাও শুকনা ভালোবাসতে শিখেছি । এখন ক্যাট্রিনা হইলো আদর্শ । আমাদের ভ্যালু বদলাচ্ছে । আমরা চাই আর না-ই চাই , আমাদের আদর্শ বদলে যাচ্ছে । শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বের মানুষের মাথায় হাতুড়ি পিটা করে শিখানো হচ্ছে , ক্যাটরিনা মানে সাফল্য , ক্যাটরিনা মানে আদর্শ । যার সব টুকুই মিথ্যা আর ভয়াবহ রকমের প্রেজুডিসড, রেসিস্ট , পাশবিক।
এখন প্রশ্ন হইলো সারাজীবন মাল্টিন্যাশনালে চাকরী করে আমরা সবাই কি মাল্টিন্যাশনালের মালিক হইতে পারবো ?
সারা জীবন লাক্স , চ্যানেল আই এর সাথে গা ঘষাঘষি করলেই কি আমরা সবাই সুপারস্টার হইতে পারবো?
এখন এই -গ্ল্যামারই জীবনের সাফল্যের মাপকাঠি- ধরনের ব্রেইন ওয়াশে দর্শকের দেহকামনা , ধর্ষকামী ভূতের আছর আসলো কেন? এদের ভূমিকাই বা কি?
পড়ুন ৩য় পর্ব ।
১ম ও ২য় পর্ব থেকে যদি সার সংক্ষেপ কিছু নিতে চান তাহলে নিচের উপলব্ধি গুলো গুরুত্বপূর্ণ ।
১। আজকের বিশ্বে কর্পোরেট দুনিয়া আমরা কি খাব, কি পরবো, কি রকম বাড়িতে বাস করবো, কি ধরনের মূল্যবোধকে দাম দেব, কিসে বিনোদিত হবো , কাকে বিয়ে করবো , কোন অবস্থানকে জীবনের সাফল্য আর কোনটাকে জীবনের ব্যর্থতা হিসেবে মানবো - এই সব কিছুই ঠিক করে দেয় । ( কারন, একই মালিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , সেবা খাত আর পলিটিকাল দলকে চালায়)
২। এই কর্পোরেট দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হইলো মিডিয়া । বিশেষ করে মাল্টি মিডিয়া যা প্রতিনয়ত এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর সুবিধা ও লাভ অনুযায়ী আমাদের ভ্যালু সিস্টেম ( কিসের মূল্য কত টুকু) , আমাদের কালচার, আমাদের জীবন দর্শনকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে । যা কিছু ব্যবসার সহায়ক তাকে উৎসাহ দিচ্ছে , যা কিছু ব্যবসার পথে প্রতিবন্ধক তাকে খারাপ বলে শিক্ষা দিচ্ছে ।
৩। এইটা করাটা খুব বেশি জরুরী কারন মানুষ যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করা শুরু করলেই এই দানব মাল্টিন্যাশনাল গুলা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে । আরো একটা কারণে এই মিডিয়ার প্রচার প্রয়োজন কারণ , পুঁজিবাদ বেঁচে থাকার জন্য একটা কাজ প্রতিনিয়ত করে তা হলো প্রফিট । অর্থাৎ , প্রফিট বা লাভ ছাড়া পুঁজিবাদী মার্কেটিং সিস্টেম বাঁচতে পারে না । এইটা কোন সেলফ সাস্টেইনেবল সিস্টেম না বরং সেলফ ডিস্ট্রাক্টিভ সিস্টেম। ক্রমাগত বাড়তে না পারলে পুঁজিবাদী মার্কেট ভেঙে পড়ে ।
একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝাই । আগের পোস্টের গরুটাকে মনে আছে ? ওই যে , লাভ করার জন্য আপনি পাড়াপ্রতিবেশীকে গাভী বেচে দেওয়ার জন্য ছল, বল ও কৌশল ব্যবহার করলেন? এখন এই পুরা উৎপাদন প্রক্রিয়াটিতে কর্পোরেট পুঁজিবাদ লাভ করে দুই ভাবে । এক হলো , শোষন ( শ্রম শোষণ) , আর ২য় হল উৎপাদনের বেশি দামে বিক্রি ।
কর্পোরেট বাণিজ্য-তে আপনার গরু (ছিলো), আপনার গরুর দুধ এখন একবার দুয়ানোর জন্য ( আমি কিনে নেওয়ার পর) শ্রম দিবেন, তারপর কেনার জন্য শ্রম দেবেন , তারপর বেঁচার জন্য শ্রম দিবেন । সুতরাং, কইয়ের তেলে কই-ই শুধু ভাঁজছি না আমি , একটা মাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাঝে আমি আপনাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধাপে শোষনও করছি ।
২য় পদ্ধতিতে লাভ করতে হলে চাই বিক্রি । বিক্রি করতে হলে চাই ডিমান্ড । ডিমান্ড ক্রিয়েট করতে হলে চাই নতুন নতুন বাজার বা কঞ্জিউমার / ক্রেতা। মানে, বাজারে সকল ক্রেতার কাছেই যদি দুধ থাকে তাহলে আমার দুধ আর বিক্রি হবে না । সুতরাং হয় আমাকে,
১। সকলের দুধ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে (স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ডিমান্ড তৈরী)
২। নাইলে নতুন ক্রেতা খুঁজে নিতে হবে ( নতুন ক্রেতা মানে নতুন ডিমান্ড)
৩। বা মানুষের দরকার থাকুক আর নাই থাকুক , ক্রেতাকে দিয়ে যে কোন মূল্যে দুধ কেনাতে হবে । ( কৃত্রিম ডিমান্ড বা মিথ্যা ডিমান্ড তৈরী)
আমাদের লাক্স কিংবা চ্যানেল আই বাঁচে এই ৩য় প্রকার ডিমান্ড তৈরী করার মধ্য দিয়ে । প্রসাধন জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় না । যেমন জরুরী না টিভি দেখা । এমন কি খাদ্য কিংবা জীবন্রক্ষাকারী ওষুধ এর মত জরুরী পণ্য হলেও যদি তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে উৎপাদিত হয় (মার্কেট স্যাচুরেশন করে ফেলে, যেমন পানিতে লবণ ঢালতে ঢালতে এক সময় যখন পানি আর লবণ নিতে পারে না) অথবা দাম বেশি বলে ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন কর্পোরেট পুঁজিকে দৌড়াতে হয় নতুন ক্রেতা ধরতে - থাকলে খুঁজে নাও , না থাকলে বানাও ।
বিল গেটস শিক্ষা দীক্ষা নিয়ে আকুল হইতেন না; যদি না কম্পিউটার কেনার জন্য এবং ব্যবহারের জন্য একটা নির্দিষ্ট লেভেলের শিক্ষা, দরকার না হইত ।
এখন পৃথিবীর সকল জায়গায় কোন দুইটা জিনিসের ডিমান্ড চিরকাল থাকবে , যতদিন মানুষ থাকবে , ততদিন থাকবে?
১। খাদ্য । যেইখানেই জীবন থাকবে সেইখানেই ক্ষুধা থাকবে।
২। সেক্স । যেইখানেই মানুষ থাকবে , সেইখানেই সেক্স থাকবেই ।
লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার এই দ্বিতীয় বাজারটির কারবারী । কি করতে হবে? সুন্দর হইতে হবে । কেন সুন্দর হইতে হবে? সুন্দর হইলে সুপারস্টার হওয়া যাবে । কেন সুপারস্টার হইতে হবে? সুপারস্টার হইলে সেক্সের বাজারে দাম বাড়বে ( সেই সেক্স বিবাহের বাইরেই হোক আর ভিতরে ) । এর সাথে আনুসাঙ্গিক হিসেবে টাকা, প্রভাব, খ্যাতি - কে না চায় এই সব?
কি ভাবে মিথ্যা ডিমান্ড তৈরী করে টিভি মিডিয়া ?
আমাদের চাওয়া এবং প্রয়োজনের বোধকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে দিয়ে।
হাত ধোয়ার সাবানের মার্কেট শেষ । তাইলে সাবান এখন কেন দরকার? সুন্দর হওয়ার জন্য । শীত বা গরম ও লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য যতটুকু কাপড় মানুষ এর দরকার হয় , এখন তার চেয়ে অনেক বেশি কাপড় উৎপাদিত হয় । তাই কি দরকার ? ফ্যাশন । বিউটি সোপ আর ফ্যাশনেবল কাপড় এ বাজার ছেয়ে গেছে । তাইলে এখন কি দরকার ? এখন দরকার সুপারস্টার হওয়া ।
আসেন দেখি কর্পোরেট পুঁজিবাদ ইউনিলিভার কি ভাবে এই ফলস ডিমান্ড তৈরী করে?
বিশ্ব ব্যাপী সুন্দরের যেই সংঙ্গা কর্পোরেট গুলা তৈরী করেছে , তার মূলে আছে মানুষের অদম্য কামনা । যা মানুষ হতে পারবে না কোন দিন -তাকেই আদর্শ হিসেবে সেট করে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মিডিয়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে । কি রকম?
১। আফ্রিকা ও এশিয়ার উপমহাদেশে সারাক্ষণ প্রচার হচ্ছে ফর্সা হউন।
ইউরোপ ও আমেরিকায় সারাক্ষণ প্রচার হচ্ছে , কালো (ট্যান) হউন।
২। কালো চুলের মেয়েদের সারাক্ষণ দেখানো হচ্ছে , কালোদের স্ট্রেইট চুলে বেশি ভালো লাগে। আর যাদের চুল এম্নিতেই স্ট্রেইট , সেই সাদাদের দেখানো হচ্ছে কোকড়া চুল বেশি সেক্সি ।
৩। শুকনা মেয়েদের - তোমার বড় বুক নেই । মোটা মেয়েদের - তোমার চিকন কোমর নেই।
৪। খাট পুরুষদের - লম্বা হউন। লম্বা পুরুষদের - মাস্কুলার হউন। মাস্কুলার পুরুষদের - যৌণ শক্তি বাড়ান।
মানে , আপনি ফর্সা, কালো, খাট - লম্বা, চিকন - মোটা - যাই হোন না কেন , আপনার শান্তি নাই । আপনি কিছুতেই সেক্সের যোগ্য না । প্রেমের যোগ্য না। ভালোবাসার যোগ্য না। সম্মানের যোগ্য না । আপনি কিছুতেই সফল না না না না না, যতক্ষণ না তাদের পণ্যটি ব্যবহার করছেন । আমি যতই বলি আপনি পারফেক্ট , আপনি বিশ্বাস করবেন না , কারণ মিডিয়া আপনাকে সারাক্ষণ শিখাচ্ছে , আপনি পারফেক্ট নন। ইউ নিড মোর । মোর মানি।মোর সেক্স । মোর মোর মোর ।
এই ঝামেলায় কি খালি মেয়েরাই? নাহ। নিঃসন্দেহে মেয়েরা তাদের দেহ এবং রুপ দিয়ে বিচার্য হয় বলে ৯০% টার্গেট মেয়েদের শরীর । ত্বক, বুক, নিতম্ব, মুখমন্ডল - আমাদের সমস্যার অন্ত নেই আর কোম্পানি গুলার সমাধানেরও অন্ত নেই । কিন্তু ছেলেরাও কম ঝামেলায় নেই । ৪২ ইঞ্চি ছাতি , ব্র্যাড পিটের নিতম্ব আর সিক্স প্যাক না হইলে চলবে না । এদিকে আবার দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী পুরুষ গুলা সব ভুড়িয়াল , তাতে কি? সব কয়টা নোবেল প্রাইজ উইনারও অতি সাধারন দেখতে, তাতে কি? অবশ্য পুরুষের সাফল্য মানে সাধারণত দেহ নয়, কাড়ি কাড়ি টাকা । সোজা ভাষায় যা আপনি হইতে পারবেন না ( বায়োলজি, ইকোনমি কিংবা সোসাল কারনে), তা হইতে উদ্বুদ্ধ করাটাই হইলো মার্কেটিং , ব্রেইন ওয়াশিং এর কাজ ।
অতএব লাক্স এবং চ্যানেল আই এর কাজ হইলো বঙ্গবাসীকে আগে এইটা শিখানো ,
হোয়াট ইজ সেক্সি? ( উত্তর অতি অবশ্যই লাক্স সুন্দরী। এইটা তো লাল সালুর ব্লগে প্রমান হয়েই গেছে যে লাক্স এই কাজে পুরাপুরি সফল হয়েছে )
এই জন্য চোখ , ঠোঁট আর ভঙ্গিমায় আবেদন খুঁজে বেড়াইলেন আমাদের দাদু শামসুল হক ।
পরের ধাপ হইলো ,
হু ইজ সেক্সি ? ( উত্তর অতি অবশ্যই যারা লাক্স সুন্দরীদের মত দেখতে, চলনে, বলনে ইত্যাদি । এইখানেও তারা সফল)
এর পরের ধাপ, মানে আসল ধাপ , আপনি কিভাবে সেক্সি হবেন? ( লাক্স , জগৎজোড়া বিখ্যাত কোম্পানির প্রসাধন ব্যবহার করতে হবে )
প্রথম পোস্টের কথা মনে আছে ? ঐ যে বলেছিলাম , একই কর্পোরেট অঙ্গের বিভিন্ন ব্যবসার হাত? মিমি কাপড়ের ব্যবসা, সুবর্ণা এ্যাড মেকার , শামসুল হক চিত্রনাট্য লেখক । তাহসিন, ইষানা , মেহজাবিনরা পণ্য নন , পণ্যের বিক্রেতা । এরা একই কর্পোরেট বাণিজ্যের এক একটি অনুসঙ্গ । সকলেই একটি মাত্র উৎপাদন থেকে বিক্রি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত !
দর্শকদের দেহ কামনাঃ
আগেই বলেছি , যেখানেই মানুষ থাকবে সেইখানেই সেক্স থাকবে। হয় প্রকাশ্যে নয় গোপনে। এইটা মানুষের মৌলিক চাহিদা । এর ডিমান্ডের শেষ নাই । তাই সাপ্লাইএর ও শেষ নাই। যারা " মা বোনেরা বেশ্যা হয়ে গেলো " বলে বোল তুলেছে তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, ২০০০ বছর আগেও বঙ্গে বেশ্যালয় ছিল। তখন লাক্স চ্যানেল আই ছিলো না । কিন্তু আমার-আপনার বাপ, ভাইয়েরা ছিলো বলে ডিমান্ড ছিলো । তাই সাপ্লাইও ছিলো । ইট ইজ দ্যাট সিম্পল। লাক্স চ্যানেল আই ডিমান্ড তৈরী করছে না । তৈরী হয়ে থাকা ডিমান্ড নিয়ে ব্যবসা করছে শুধু ।
সেক্স হলো বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্য । হয় সেক্স , না হয় সেক্সুয়ালিটি। ৪ বিলিওন মানুষ এর ক্রেতা অথবা বিক্রেতা ( এক তৃতীয়াংশ মানুষকে শিশু ধরে নিয়ে বাদ দিলাম) সারা বিশ্ব জুড়ে । তাহলে বুঝেন এর ডিমান্ড কেমন?
লাক্স, ইউনি লিভার এর নতুন করে ডিমান্ড তৈরী করার দরকারই নাই , দরকার শুধু এই ডিমান্ডের সাথে তাদের পণ্য গুলাকে এলাইন করা , আমাদের বুঝানো যে তাহাদের পণ্য , মাখিলেই বন্য!
তার মানে কি তারা নারীকে পণ্য করছে না? অবশ্যই করছে । শুধু নারী কেন, তারা পুরুষ ও বাচ্চাদেরও পণ্য করছে । কেন খেয়াল করেন নাই? ২০০০ বছরে হয় নাই , আজ কাল হঠাৎ করেই বাচ্চাদের ত্বক শুষ্ক আর খসখসে হয়ে উঠেছে ? যেই দিন থেকে লাক্স বেবি লোশন ক্রিম নিয়ে মাঠে নেমেছে সেইদিন থেকে আমাদের শিশুরা ত্বকের আর্দ্রতা হারাচ্ছে ?
আগেই বলেছি , নতুন ক্রেতার বাজার তৈরী করতে না পারলে এই সর্বগ্রাসী প্রফিট ওরিয়েন্টেড কর্পোরেট পুঁজিবাদ বেঁচে থাকতে পারে না । মা বোনের , কিশোর কিশোরীদের মার্কেট স্যাচুরেটেড হয়ে গেছে , এখন তাই বাচ্চার চামড়া দরকার , ব্যবসার জন্য !
আমি খুবই দুঃখিত, এই পর্বেও শেষ করতে পারলাম না । পরের পর্বে আশা করি শেষ করতে পারবো ।
পড়ুন শেষ পর্ব ।
আগের পর্ব গুলা থেকে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে,
১। যেই কর্পোরেট বাণিজ্য গুলাকে আমরা ভিন্ন ভিন্ন সেক্টর , ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা বলে মানি , সেই গুলো হতেই পারে একই বাণিজ্যিক মালিকের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা (গরু কাহিনী)। আর যদি তা নাও হয় , তারপরেও তারা একই প্রোডাকশন লাইনের ( এন্টারটেইন্মেন্ট মিডিয়া) বিভিন্ন পর্যায়ে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এবং সার্ভাইভালের জন্য একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল। অর্থাৎ , মিমির কাপড়ের ব্যবসা সুবর্ণার নাটকের উপর , সুবর্নার নাটক হকের লেখার উপর, হকের নাটকের প্রচার ইউনিলিভারের বিজ্ঞাপনের উপর, ইউনিলিভারের বিজ্ঞাপন ফুয়াদের জিঙ্গেলের উপর , ফুয়াদের জিঙ্গেল পণ্যের মডেলের উপর এবং পণ্যের মডেল দর্শকের সেক্স ও সেক্সুয়ালিটির উপরে নির্ভরশীল। এই সম্পর্কটি লিনিয়ার নয় বরং মাকড়সার জালের মত ইন্টারকানেক্টেড।
২। এনটারটেইনমেন্ট মিডিয়ার কর্পোরেট দুনিয়া নিজেদের এবং পৃষ্ঠপোষক ( এবং শোষক) ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাভের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রতিনয়ত এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলার সুবিধা ও লাভ অনুযায়ী আমাদের ভ্যালু সিস্টেম ( জীবনের কোন জিনিস, কোন শিক্ষা , কোন অনুভূতি সবচেয়ে মূল্যবান , তুলনামূলক ভাবে কিসের মূল্য কত টুকু) , আমাদের কালচার, আমাদের জীবন দর্শনকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করে। যা কিছু ব্যবসার সহায়ক তাকে উৎসাহ আর যা কিছু ব্যবসার পথে প্রতিবন্ধক তাকে খারাপ বলে শিক্ষা ব্রেইন ওয়াশ করতে থাকে।
৩। এইটা করাটা খুব বেশি জরুরী কারন মানুষ যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করা শুরু করলেই এই দানব মাল্টিন্যাশনাল গুলা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে ।
গরু কাহিনীতে ফেরত যাই । মনে করুন, হঠাৎ একদিন আপনার প্রতিবেশীরা ঘুম থেকে জেগেই উপলব্ধি করলেন , তাদের গরুগুলো ( উৎপাদনের যন্ত্র ) যেদিন থেকে হাতছাড়া হয়েছে , সেদিন থেকেই তারা আমার দাসানুদাস হতে শুরু করেছেন। এই উপলব্ধি হলে তারা কি আমাকে ছেড়ে কথা বলবেন ? আন্দোলন করে ফাটিয়ে দেবেন না ?
নাহ ।
ভুলে গেছেন , আমার কাছে গরু বেচতে আমি বলিনি , বলেছেন আপনি ! একটু অনুসন্ধান করে এই সত্যও বের করা কঠিন না যে নিজের দুধের বিক্রি বাড়ানোর জন্যই আপনি এই ছলের আশ্রয় নিয়েছিলেন । ফলে মানুষ লাঠি নিয়ে পিটা লাগাবে আপনাকে । আর আমি? আমার কিছুই হবে না । এলাকায় স্কুল, হাসপাতাল, ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকারী আমি প্রেস কনফারেন্স করবো , " এই দেশের কোন এবিলিটি নাই। পলিটিকাল স্ট্যাবিলিটি নাই। আমি চললাম মালয়শিয়া , ওরা আমার মুসলিম ভাই !" দেশের একজন বিশিষ্ট ইনভেস্টরকে তাড়ানোর জন্য আপনি ও আপনার প্রতিবেশীরা পিটা খাবেন এরপর । দয়া পরবশ হয়ে আমি ব্যবসা গুটিয়ে ( বিক্রি করে) চলে যাওয়ার আগে সেই বুড়া গরুগুলিকে
১০ গুণ দামে আপনাদের কাছেই বিক্রি করে দিব , আন্দোলন থেমে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে । আমি মহান রয়ে যাব। ( গরুর জায়গায় কৃষি জমি কিংবা অন্য যে কোন উৎপাদন্মুখী খাতকে বসিয়ে নিতে পারেন। )
এখন কথা হইলো , এই হঠাৎ করে জাগার কারন কি? মালয়শিয়া যদি বুঝে আপনারে খেপাইলে ব্যবসা তার দ্বারে যাবে তাইলে মালয়রা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে আপনার জ্ঞানচক্ষু খুলার জন্য " দা ইভিল অফ ক্যাপিটালিজম" ক্লাস নিবে। তবে , আপনি আমার কাছে গরু বিক্রির আগে না , অবশ্যই পরে।
যে সময়টা জেগে উঠলে আপনার লাভ , সেই সময়ে চক্ষু খুলার একটাই উপায়, তা হলো শিক্ষা ও জ্ঞানের চর্চা। সারা দুনিয়া জুড়ে কে কি কেন করছে , সেই পলিটিকাল জ্ঞান থাকা। স্বচ্ছ ও অবাধ তথ্যের আদান প্রদান ও সেই তথ্যের মিনিং বুঝার জ্ঞান । আমেরিকা ইরাক আক্রমন করেছে - এইটা তথ্য । আমেরিকা ইরাক থেকে তেল নিবে বলে আক্রমন করেছে হইলো জ্ঞান । আর তেলের পাইপ লাইন টানার জন্য আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে ডিক্টেটরশীপ গুলাকে পয়সা দিয়ে পালছে- এইটা হইলো মিনিং । আমি মালয়শিয়া পালানোর আগেই আমাকে ধরতে হলে কিংবা ঠেকাতে হলে এই মিনিংটা বুঝতে হবে ।
লাল সালুর আক্রমনের টার্গেট মেয়ে গুলা , বড় জোর বিচারক । তার পিছনে চ্যানেল আই না । চ্যানেল আই এর পিছনে লাক্স না। লাক্সের পিছনে ইউনিলিভার না। আগেই বলেছি , লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার জাতীয় প্রতিযোগিতা গুলো সেক্সের ডিমান্ড তৈরী করে না । যে ডিমান্ড সমাজে তৈরী হয়েই আছে , অত্যন্ত সুস্থ এবং স্বাভাবিক জৈব চাহিদা হিসেবেই আছে , তাকে ব্যবসার খাতিরে ব্যবহার করে, উস্কে দেয় । ছেলেদের ধরে ধরে সুড়সুড়ি দেওয়াই যে এর মূল উদ্দেশ্য ঠিক তা না , তবে অস্থির করলে এই বেনিয়াদেরই লাভ। পণ্য বিক্রি ও পণ্যের বিপণণ আসল উদ্দেশ্য হইলেও সমাজকে বিশেষ করে তরুন সমাজকে অস্থির করে রাখলে এই বেনিয়াদের যেই লাভটা হয় তা হলো , অস্থির মানুষ চিন্তা ভাবনা করে কম। ক্রিয়া করে কম, করলেও সেইটা রতিক্রিয়াই হবে, তবে রতিক্রিয়ার চেয়েও অনেক বেশি করে প্রতিক্রিয়া। কোন কিছু নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করতে চাইলে চাই শান্ত মন। সুস্থির বিবেক। চাই যুক্তি ও জ্ঞানের সঠিক সম্মেলন। কিন্তু এই সুড়সুড়ি মার্কা প্রতিযোগিতাতে অস্থির যুবকরা অস্থির হয়ে উঠে তাদের প্রতিবাদের ভদ্র ভাষাটাও ভুলে যায় । লাল সালুর ব্লগ পোস্টে তার স্পষ্ট প্রমান আছে । অস্থির , অসংলগ্ন মানুষকে প্রভাবিত করা বা ব্রেইন ওয়াশ করা অনেক সোজা। সুতরাং তুমি লাক্স কেনো আর নাই কেনো , মানুষ যত অস্থির , তত প্রতিক্রিয়াশীল, যত প্রতিক্রিয়াশীল তত দুর্বল , যত দুর্বল ততই সহজ তার কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রন করা ।
এই জন্যই সুস্থির , চিন্তাশীল সমাজ ও সামাজিক জীবন পুঁজিবাদের পছন্দ না । পুঁজিবাদের চাই অস্থির গতি , আরো আরো আরো গতি ! মানুষ সারাক্ষণ ছুটবে । হয় রোজগার নেই বলে ছুটবে , নয়ত রোজগার আছে বলে ছুটবে। আর খাবে । কামাবে আর খরচ করবে। মুখ দিয়ে খাবে । চোখ দিয়ে খাবে । মন দিয়ে খাবে। স্পর্শে খাবে, গন্ধে খাবে , চিন্তা চেতনায় খাবে । এই গ্রহন গুলো থেকে সে কিছু অর্জন করবে না , স্রেফ হজম করবে । কিছুই চিন্তা করবে না , পাগলের মত চ্যানেল ঘুরাবে , ছাগলের মত ফাস্ট ফুড চিবাবে , উঠতে বসতে ছটফট করে বেড়াবে - তাইলেই লাভ, লাভই লাভ!
চিন্তাশীল মানুষ নিজের বিপদ টের পায় সবার আগে । অস্থির মানুষ টের পায় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। এখন তাই ফাস্ট এর জয় জয়কার সারা মিডিয়া জুড়ে । শিল্পী ( স্লো পদ্ধতি ) চাই না, স্টার (ফাস্ট) চাই। ফাস্ট ফুড , ফাস্ট সেক্স , ফাস্ট লাইফ !
কারন যেই মুহুর্তে আপনি চিন্তা করতে শুরু করবেন , আরেকটা সিম কেন কিনবো? কি লাভ? আরেকটা গাড়ি কেন লাগবে? ইষানা কেন, কুলসুমও তো সুন্দরী ! ৮০০ টাকা দিয়ে চিকেন ফ্রাই কেন খাব , বাসাতে ১২০ টাকা দিয়ে নিজেই বানাতে পারি তো! ক্যাটস আই এর শার্ট লাগবে কেন? শার্ট তো শার্টই ! - সেই মুহুর্ত থেকে আপনি পুঁজিবাদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠলেন ।
পুঁজিবাদ চিন্তাবিদ চায় না। চায় ক্রেতা । যে খালি কিনবে আর কিনবে । আসলেই দরকার আছে না নাই, এই সব ভাববে না । তাকে শেখানো যাবে - বিজ্ঞাপন বলেছে দরকার , তাই দরকার!
পুঁজিবাদের সবচাইতে বড় শত্রু তাই কমিউনিজম নয় , সোসালিজম নয় । পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় শত্রু সচেতন , চিন্তাশীল মানুষ যা তাকে যুক্তিবাদ ও র্যাশনাল কেনা বেচা লেন দেন শিখায় । পুঁজিবাদের বড় শত্রু প্রাচ্যের জীবন দর্শন যা মানুষকে নির্লোভ ও আত্মত্যাগী ও সংযম শিক্ষা দেয় । যা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় , অন্যের ক্ষতি করে নিজে লাভবান হওয়াটা লাভ নয়, ক্ষতি । ঠিক একই কারণে পুঁজিবাদ এর বড় শত্রু ইসলাম । কারন, ইসলাম বলে দুনিয়াতে এত কেনাকাটার দরকার নাই , আখিরাতেই সব কিছু পাবা । ( আরব আমিরাতের ইসলাম না , আমাদের উপমহাদেশের সুফিবাদী , আত্মত্যাগী , নির্লোভ ও অল্পে সন্তুষ্ট জীবন দর্শন ধারী ইসলাম যেই দর্শনের দেখা পাওয়া যায় উপমহাদেশের হিন্দু ও বৌদ্ধ বিশ্বাসেও। ) পরকালের সুখের জন্য ইহকালে ত্যাগী জীবনযাপন করাটা পুঁজিবাদী বাণিজ্যের জন্য বিশেষ অপকারী ।
ঠিক এই কারণেই বাংলাদেশে ইদানিং মিডিয়া বিস্ফোরন ঘটেছে । একের পর এক প্রিন্ট , টিভি মিডিয়া আসছে । জনগণের উন্নতির জন্য আসছে ? নাহ । বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া তথা উপমহাদেশের জীবন দর্শন , যাতে ভোগের বদলে ত্যাগ , উপভোগের বদলে উপলব্ধি আর ইন্দ্রিয় সুখের বদলে ইবাদতের কথা বলা হয়েছে । এই দেড় বিলিওন ক্রেতার মন মানসিকতা চেঞ্জ করে পুঁজিবাদ নামক নতুন ধর্ম শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এই মিডিয়া এসেছে এবং মাল্টিন্যাশনাল গুলা এদের পেছনে এত টাকা ঢালছে । কালচারাল ও পলিটিকাল মূল্যবোধ , ধ্যান ধারনা বদলে মুনাফালোভী করে তোলা , পণ্যের প্রচার ও নতুন ধর্মে ( পুঁজিবাদ) দীক্ষা দেওয়ার জন্য এই এনটারটেইনমেন্ট মিডিয়ার কোন জুড়ি নেই। আমেরিকা , ইউরোপ জয় করে পরীক্ষীত ও সফল অস্ত্র হিসেবে এটি প্রচার হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশে । সুন্দরী প্রতিযোগিতা , ফুয়াদের সেক্সি গান আর লস প্রজেক্ট মার্কা ফারুকী বর্জ্য এই বিপুল " ব্রেইন ওয়াশ " কার্যক্রমের অংশ মাত্র!
অস্থির করার পাশাপাশি ছেলেদের মনের ভিতর কিছু নির্দিষ্ট ইমেজ তৈরী করাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্রেইন ওয়াশ । আমরা বুঝি আর নাই বুঝি , অবচেতন মনে আমরা প্রতিনিয়ত শিখছি , সুন্দর মানে মেহজাবিন। সুন্দর মানে ইষানা। সুন্দর মানে অর্ষা । আমরা যখন সুন্দরকে খুঁজবো , এই রকমই খুঁজবো। পার্থক্য শুধু তারা আমার সামনে ছাড়া আর কারো সামনে কাপড় খুলবে না । ওরাও মডেলই হবে , ভদ্র মডেল ।
এইটা আরো ভয়ংকর। ভয়ংকর এই কারণে যে একটি নির্দিষ্ট মাপ কাঠির বাইরের সবাইকে আমরা " অনাকর্ষনীয় " আখ্যা দিয়ে ফেলছি। আমরা নারী মাত্রেই শরীর বানিয়ে ফেলছি। নারীও মানুষ, অনুভূতি, মগজ সম্পন্ন - সেই বোধ হারিয়ে যাচ্ছে । আমরা বিদূষী বাদ দিয়ে বিদিশা খুঁজছি এখন ক্রমাগত । মানুষ হয়ে যাচ্ছে পদার্থ ।
এই পরিবর্তন , এই ব্রেইন ওয়াশ কতখানি সফল তার একটা উদাহরণ দেই -
প্রথম দিকের কোন পর্বে একটা মেয়ে দুর্দান্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলো , অথচ এই মেয়েদের কোন ট্যালেন্ট পর্ব আমি পাইনি খুঁজে। নিশ্চয়ই অন্য মেয়েরাও এই রকম কিছু না কিছু প্রতিভা নিয়ে এসেছিলো , কিন্তু মাংসের কারবারী ঐদিকে নজর দেয় নাই। যেই মেয়েটা " সবাই ভালো বলেছে তাই আমি কিনেছি" ধরনের প্যাসিভ বক্তব্য দিয়েছিলো , সে বাদ পড়েছে । এইটা একটা ভালো দিক যে একটা মানুষ যার নিজস্ব মতামত বলতে কিছু নাই , তাকে সাথে সাথে বাদ দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট বাজেট ও সময়ে কি করে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হয় , এইটা আমাদের সরকারী প্রোকিউরমেন্টের লোক জনও জানে না । জানাটা জরুরী । কিভাবে ক্লু দেখে রহস্যভেদ করতে হয় , কি ভাবে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয় - এই গুলা খুবই জরুরী গুণ । আমি নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি , ট্রেনিং ক্যাম্পের শিক্ষা গুলা যদি বাদ পড়া মেয়েরা নিজেদের জীবনে ধরে রাখতে পারে ( ভোর পাঁচটায় উঠে শরীর চর্চা আমারে দিয়াও হয় না) তাহলে তাদের উপকারই হবে । সঠিক নিউট্রিশন এবং ফিটনেস মানুষের অনেক বড় সম্পদ । এতগুলা ভালো ভালো দিক চোখে পড়ার পরেও আমি এই প্রতিযোগিতার পক্ষ নিতে পারছি না ।
কেন?
কারণ, সহজাত ভাবেই এই প্রতিযোগিতা যেই কর্পোরেট পুঁজিবাদিতার মন মানসিকতাকে উৎসাহ দেয় , যেভাবে একটা মানুষকে মানুষ থেকে বদলে শরীর সর্বস্ব অব্জেক্ট বানায় , যেভাবে শেখায় তারা ছাড়া বাকি সব অসুন্দর , সুপারস্টার না হলে জীবন ব্যর্থ - এই সব ঘৃণ্য শিক্ষা , মূল্যবোধের অবক্ষয় আর মানুষ না হয়ে ক্রেতা হওয়ার এই ইঁদুর দৌড়কে কোন ভাবেই সমর্থন করা যায় না ।
লাক্স প্রতিযোগিতায় অনেক কিছুই ছিলো , কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে শরীরটাকেই ফোকাসে রাখা হয়েছে , সব সময় ।
সবচাইতে বড় কারন ঃ
কর্পোরেট পুঁজিবাদিতার সব কিছুই ভন্ডামি আর মিথ্যাচারে ভরপুর
কি ভাবে কর্পোরেট পুঁজিবাদ আপনাকে ঘোরের ভিতরে আচ্ছন্ন করে রাখে? তাদের এই শরীর পূজাও এক বিশাল ফাঁকি !
জেনেটিক সাইন্স বলে একটা মানুষ কতটুকু লম্বা , মোটা কিংবা সুন্দর হবে তা নির্ভর করে জেনেটিক্স এর উপর । ক্রিম , সাবান , লতা পাতা ঘষে এইটার খুব একটা পরিবর্তন করা যায় না। ত্বক ফর্সা করার প্রতিটা ক্রিম ভুয়া । স্রেফ মিথ্যা । ত্বকের মেলানিন বেশি হলে আপনি কালো হবেন , মেলানিন কম হলে ফর্সা হবেন । ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমে ভয়াবহ ক্ষতিকারক কেমিকেলস থাকে।
সুন্দর ফিগারের একমাত্র উপায় হইলো খাদ্যাভাস আর শরীর চর্চা। তারপরেও মানুষের শরীর এর মাপ তিন রকম। তবে কাটায় কাটায় তিন আলাদা রকম না । মিক্সড ও আছে । তবে মোটামুটি এপেল , পিয়ার কিংবা দোহারা গড়নই বেশি। মেয়েদের বেলায় যেই আওয়ার গ্লাস ফিগারকে বিশ্ব ব্যাপী আদর্শ বানানো হয়েছে সেই মাপের দেহ পেতে পারবেন কেবল মাত্র ৫% মহিলা । বাকিদের কেউ কেউ সার্জারী করে পারবেন , তারপরেও বেশির ভাগই পাবেন না ।
তার মানে কি দাঁড়াইলো ?
প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ৫ জনের মত হওয়ার জন্য বাকি ৯৫ জন ক্রমাগত ক্রিম ঘষবেন, জিমে যাবেন, ডায়েট করবেন, বিশেষ ধরনের পোশাক পরবেন , কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে সার্জারী করাবেন। কিন্তু কেন?
কারণ , মিডিয়া আপনাকে শেখাবে , তোমার মডেল , তোমার আদর্শ হইলো আওয়ার গ্লাস । এইটা হইলো এমন এক খেলা যাতে মাঠে নামার আগেই আপনি হেরে বসে আছেন কিন্তু আপনাকে প্রতিনিয়তই ব্রেইন ওয়াশ করা হচ্ছে যে , আপনি জিতে যাবেন , আর একটা কিছু কিনলেই!
হু দা হেল আর দে টু টিচ আস হোয়াট ইজ , হু ইস বিউটিফুল? হু ইজ নট?
বাঙালী কয়টা ছেলের সিক্স প্যাক থাকে? সিক্স প্যাক না থাকলেই অন্য কারো গলায় ঝুলে পড়তে হবে? ব্লিঙ ব্লিঙ ডায়মন্ড রিং দিতে না পারলে রাস্তা মাপো ?
আওয়ার গ্লাস না হলে ভালোবাসা যাবে না?
এই প্রশ্ন গুলা আপনি তখন করবেন যখন আপনি একজন মুক্ত চিন্তার, যুক্তিবাদি , স্বাধীন মতের মানুষ হবেন । বিজ্ঞাপনের চটকে বিভ্রান্ত হবেন না । আমরা কয়জন তা পারি?
মানুষের সব চাইতে বড় সৌন্দর্য তার বৈচিত্র । বিচিত্র মানুষ তার বিচিত্র শরীর নিয়ে প্রেম , ভালোবাসা, সেক্স নিয়ে সুখে থাকুক। এইটাই হওয়া উচিত ।
কিন্তু মিডিয়া মোঘলরা , ফ্যাশন এন্ড কসমেটিকদের সাথে হাত মিলিয়ে আমাদের ব্রেইনে সুন্দরের একটা ফিক্সড ইমেজ গেঁথে দিতে বদ্ধ পরিকর । তাও আবার সেইটা শরীর এবং শরীর এর পূজারী।
-----------------------------------------------------
এই ধরনের বিজ্ঞাপন কি আসলেই মানুষকে অন্ধ করতে পারে ?
পারে । গবেষনায় দেখা গেছে একটা সৌন্দর্য পণ্য আদৌ কাজ করে কি করে না তা জানার দরকার নাই । ক্রেতা যদি বিশ্বাস করে যে পণ্যটা কাজ করলেও করতে পারে , তাহলেই চলবে । মানুষের কল্পনা ও সহজাত প্রবৃত্তি এর জন্য দায়ী। খুব ইমেডিয়েট , ক্ষুদ্র সাফল্যকে আমরা বড় করে দেখি । এবং ক্ষুদ্র সাফল্যের উপরে বেস করে বড় বড় রিস্ক নেই । এইটা একটা গেম অফ চান্স ।
লাস ভেগাসে ৯৮% ক্ষেত্রে জুয়াড়িদের জিততে দেওয়া হয় । মাত্র ২% লাভ করা হয় । আর এই মাত্র ২% লাভ দিয়েই মিলিওন মিলিওন ডলারের ব্যবসা চলে । কারন, মানুষ যতক্ষণ বিশ্বাস করবে , " আর একবার খেললেই সে জিতবে " - ততদিন লাস ভেগাসের ব্যবসা সেইফ । আর এক টিউব ফেয়ার এন্ড লাভলী মাখলেই আপনি ফর্সা হবেন ( পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও) , ইউনি লিভারের ব্যবসা সেইফ । স্রেফ হাওয়ার উপরে, মিথ্যার উপরে, ছলনার উপরে সাজানো এই ট্রিলিওন ট্রিলিওন ডলারের প্রসাধন ব্যবসা।
ক্রিম ঘষে আর সার্জারী করেই যদি এনজেলিনা জোলি হওয়া যেত, খোদ হলিউডেই প্রতিদিন ১০টা করে এনজেলিনা পয়দা হইত না?
----------------------------------
শেষের অংশটুকু আসলে লাল সালুর পোস্টে বলা হয়ে গেছে । সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে কামার্ত ব্লগাররা যেই হারে তাদের আদিরসাত্মক ফান করলেন আর দেশের ১০ হাজার " সম্ভাব্য পণ্য বিক্রেতাকে" বেশ্যা বানিয়ে ফেললেন , সেইটা আমার কাছে সেই ১৯৭১ এর ধর্ষকামী ভূতের আছর মনে হয়েছে। একটা মানুষের উপর চড়াও হওয়া তখনই সম্ভব যখন কোন ভাবে সবাইকে কনভিন্স করা সম্ভব যে তারা মানুষ নয় , আমাদের সমান নয়।
The first step towards the most horrific atrocities against human kind is to establish that they are "less than human" , less than what you are .
This happened with black slaves in Africa, this happened with the witch hunt in Europe, this happened with Jews in the holocaust, this happened exactly with 30 lakh people and 2 lakh women in the 1971 genocide in Bangladesh.
Not because they were black.
Not because they were witches.
Not because they were Jews.
Not because they were Bangali.
Because , they were less than human to their oppressors.
পূর্ব পাকিস্তানের মেয়েরা মানুষ নয় । ওরা হিন্দু। ওরা হিন্দুয়ানী ভাষায় কথা বলে। হিন্দুয়ানী পোশাক (শাড়ি) পরে । হিন্দু আচার সংস্কৃতি পালন করে । ওরা মুসল্মান নয় । সুতরাং উহারা মানবেতর ( মানুষের চেয়ে ইতর) প্রাণী ।
অতএব , পূর্ব পাকিস্থানী হিন্দু মেয়েদের খান সেনাদের খাট কাঁপানোর জন্য দিয়ে দেওয়া হউক।
-----------------------
লাক্স সুন্দরীরা বাঙ্গালী নয় । ওরা পশ্চিমা । ওরা বাংলা বলতে পারে না, ওরা খোলামেলা পোশাক পরে , ওরা পশ্চিমা আচার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত । ওরা মুসলমান নয় । সুতরাং উহারা মানবেতর ( মানুষের চেয়ে ইতর ) প্রানী ।
সুতরাং , ইহাদের দিয়ে খাট কাঁপানো হউক।
-----------------------------------
দুইটা গল্পে আমি কোন পার্থক্য পাই না ।
প্রথম গল্পে পাকিস্তানী জোশে জোশিলা রাজাকার ।
দ্বিতীয় গল্পে পাকিস্তানী জোশে জোশিলা বাঙ্গালী ।
সন্দেহ নাই , এই ধরনের প্রতিযোগিতাকে আমি সমর্থন করি না । কিন্তু প্রতিবাদ কিংবা ফানের নামে প্রতিযোগিনীদের সম্ভাব্য বেশ্যা বলে অপমান করাটা কিছুতেই সহ্য করা উচিত না । যেই ১০ হাজার মেয়ে অংশ নিয়েছে তারাও মানুষ । তাদের লাইফ চয়েস নিয়ে আমাদের আপত্তি থাকতে পারে , তার মানে এই না যে আমরা যাচ্ছেতাই ভাবে তাদের হেয় করবো, অবমাননা করবো।
-----------------------------------------------------
সুন্দরী প্রতিযোগিতা কিংবা কর্পোরেট পুঁজিবাদ কেবল নারী নয় , সবাইকেই পণ্য বানায় , ক্রেতা বানায় । হয় তুমি বিক্রি করবে নয় তুমি বিক্রি হবে । কারন এই মতবাদের মূলে আছে শুধুই লাভ , কেবল সাপ্লাই আর ডিমান্ড ।
কিন্তু মানুষের সবচেয়ে বড় যেই ডিমান্ড ,
ভালোবাসা । আধ্যাত্মিক বা স্পিরিচুয়াল নিড । মূল্য পাওয়া বা মূল্য দেওয়া । সম্মান ও সাফল্যের ভিতরে প্রচ্যের যেই দর্শন রয়েছে , সেই দর্শনকে পুঁজিবাদ ধ্বংস করতে চায় ।
আমরা যে বিশ্বাস করি , এই জীবনটাই সব নয় , এইখানে সব কিছু পাওয়ার নেশায় আশে পাশের সবাইকে, ন্যায় - নীতি - মূল্যবোধকে পায়ে দলে যাবার দরকার নেই ! সব কিছু খুবলে খাওয়া নয় , যা আছে - সেই সামান্যটুকুই সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়ার ভেতরে আনন্দ অনেক বেশি - এই সব পুঁজিবাদ বুঝে না ।
পুঁজিবাদ হলো সেই আগুন যা খেতে খেতে বড় হয় । যারা উচ্ছিষ্টটুকু পায়, তারা এর নানান গুণাগুণ বর্ননা করে । ইনোভেশন , ক্রিয়েটিভিটি, ডিস্কভারি , ব্লাহ ব্লাহ ।
কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে , কিসের মূল্যে ? এট দা কস্ট অফ হোয়াট?
------------------------------------------
আজকের যুগে আপনার বউ এর পেটে যেই ভ্রুণটা আছে সেইটাকে বের করে একজন ক্যান্সার রোগী , একজন হার্টের রোগী কিংবা একজন কিডনীর রোগীকে বাঁচানো সম্ভব।
এখন এই টেকনোলজিটাকে যদি কর্পোরেট পুঁজিবাদের সাথে তুলনা করি তাহলে , আপনি এই ধরনের পুঁজিবাদ ও অর্থনীতিকে সমর্থন করবেন কিনা তা নির্ভর করবে আপনি কি সেই
১। মা?
২। ভ্রুণ ?
৩। সার্জন ?
নাকি ,
৪। মৃত্যু পথযাত্রী রোগী?
লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার কারো কারো জন্য কিছু কিছু উপকার বয়ে আনবে এইটা সত্য। কিন্তু , প্রশ্ন সেই একটাই , কিসের বিনিময়ে? কতখানি মূল্যে?
http://www.somewhereinblog.net/blog/valobashablog/29085855
নিঃসন্দেহে সৌন্দর্য চর্চা একটা ব্যবসা । ট্রিলিওন ট্রিলিওন ডলারের ব্যবসা । এই ব্যবসার মূলে আছে মূলত কর্পোরেট পুঁজিবাদ । পুঁজিবাদ কি বলে? পুঁজিবাদ বলে প্রোডাকশন বা উৎপাদনের সব রকমের উপাদান , মালামাল বা সার্ভিস, বিক্রি ও লাভ - সব কিছুর মালিক হবে ব্যক্তি । উৎপাদন প্রক্রিয়ার লেন দেন হবে মার্কেটে এবং বেতন ও দাম নির্ধারন করবে মার্কেট । কর্পোরেট পুঁজিবাদ বলা হয় সাধারণত ঐ ধরনের ব্যবস্থাকে যেইখানে , আইন অনুযায়ী কর্পোরেশন বা সংস্থাকে হতে হবে প্রফিট ওরিয়েন্টেড । অর্থাৎ , একটা হাঁচি কাশি দিতে গেলেও সেইখানে আপনার লাভ থাকতে হবে । অর্থনীতির ড্রাইভার সমূহ একটি এবং একটি মাত্র লক্ষ্য নিয়ে আগাবে তা হলো " প্রফিট বা লাভ" ।
কমিউনিজম বা সোসালিজম এর সাথে এর মূল পার্থক্যটা হলো , কমুইনিটি বা সোসাইটির সার্বিক লাভালাভ এইখানে বিবেচ্য থাকে না । বিবেচ্য থাকে কর্পোরেট এর লাভ। মালিক যেহেতু ব্যক্তি তাই ব্যক্তিগত লাভ। তাতে সমস্যাটা কি ?
সমস্যাটা হলো , আপনাকে যখন পুরো কমিউনিটি বা সোসাইটির লাভ মাথায় রেখে লেন দেন করতে হবে , তখন আপনি এই কমিউনিটি বা সোসাইটির কোন সদস্যের কোন ক্ষতি হয় , এমন কোন লেন দেন বা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না । সুতরাং, আপনাকে এথিকাল ট্রেডিং করতে হবে । এখন একটা রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হয় , তাহলে সে তার জনগণের কাছে একাউন্টেবল এবং জনগণের জন্য অনিষ্ট করে এমন কোন সিদ্ধান্ত , ব্যবসা করতে পারবে না । দুনিয়ার কর্পোরেট গুলা যতদিন রাষ্ট্রের অধীনে ছিলো , তারাও এই নৈতিকতা মেনে চলতে বাধ্য ছিলো । কিন্তু এখন মাল্টীন্যাশনাল কোম্পানি গুলা ধনে, সম্পদে , পলিটিকাল পাওয়ারে যে কোন একটি রাষ্ট্রের অধীনে নয় । আগে রাষ্ট্র কর্পোরেটকে নিয়ন্ত্রন করত। এখন কর্পোরেটই উলটা রাষ্ট্রকে চালায় । সুতরাং , ভোটের মাধ্যমে কে নির্বাচিত হবে , সেইটাও আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। মূলত পৃথিবীর সমস্ত ধন সম্পদ, পলিটিকাল ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রন চলে গেছে জনগণ তথা রাষ্ট্রের বাইরে , কতগুলা মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেটের হাতে । ন্যায়, নীতি , উচিত , অনুচিত বলে তাই আর দুনিয়াতে কিছু নাই । সবই প্রফিট ওরিয়েন্টেড । দুনিয়া জুড়ে যেই তথা কথিত এন জি ও , ডেভেলপমেন্ট, ডোনার , হেলথ , ডেভেলপমেন্ট এইড ইত্যাদি ইত্যাদি গাল ভরা নাম আর কার্যক্রম চলে , এইটাও আসলে কর্পোরেট বাণিজ্যেরই আরেকটা রুপ । নামেই নন প্রফিট , আসলে বিজনেস।
বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে ? কল্পনা করুন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে । এদের কত্তগুলা হাত আছে ?
ক। নন আর্মস , লিগাল ব্যবসার হাত
১। পলিটিকাল দল বা রাজনৈতিক ব্যবসার হাত
২। সম্পূর্ণ ফর প্রফিট ব্যবসার হাত - যেমন কম্পিউটার, ব্যাংক , প্রকাশনা
৩। প্রফিট - নন প্রফিট মিক্স সেবা খাত হিসেবে ধরা হয় এমন ব্যবসা - হাস্পাতাল, ইউনিভার্সিটি
৪। সম্পূর্ণ নন প্রফিট ( আসলে প্রফিট) ব্যবসা - এন জি ও
খ। আর্মড ও ইলিগাল ব্যবসার হাত
১। অস্ত্র চোরাচালান ও বিক্রি
২। মাদক এবং অন্যান্য অবৈধ পণ্যের বেচাবিক্রি
৩। আদম পাচার ইত্যাদি
এখন একটু চিন্তা করে দেখেন , এই সব কয়টা হাত মিলিয়ে জামায়াত কিন্তু বাংলাদেশের একেবারে গরীবের চেয়ে গরীব এবং উপরের ধনীর চেয়ে ধনী সব কয়টা স্তরেই ব্যবসা করছে । ক্ষুদ্র ঋণ থেকে শুরু করে ভার্সিটি, ব্যাংকিং, হাসপাতাল , তার উপরে ধর্ম ও পলিটিক্স । তার মানে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ হইলাম আমরা জামায়াতের ক্রেতা গোষ্ঠী এবং আমাদের শ্রম ও শ্রমের পয়সা চলে যাচ্ছে তাদের পকেটে । তাই রাজনৈতিক গ্রহনযোগ্যতা না থাকলেও জামায়াত গেড়ে বসেছে আমাদের গলার কাঁটা হয়ে , এবং এইটা ঘটেছে গত ৩০ বছরে । ঠিক এই ভাবেই কল্পনা করুন, বিশ্বের কয়েকটা মাত্র কোম্পানি এক এক করে কিনে নিচ্ছে অর্থনীতির সব কয়টা হাত । কি ঘটবে?
সারা বিশ্বই তখন পরিণত হবে একটা বাজারে যেইখানে সকলেই ক্রেতা বা কঞ্জিউমার । যে যত বড় বা বেশি কনজিউমার , তার দাম তত বেশি। আর সকল কার্যক্রমের মূলে রয়েছে শুধুই লাভ আর লাভ। লাভ নাই তো সব বন্ধ। এর ভিতরে লাক্সের চামড়া আসল কই থেকে , এইটাই ভাবছেন তো ?
পড়ুন২য় পর্ব ।
প্রথম পর্ব থেকে দুইটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ।
১। কর্পোরেট পুঁজিবাদ চালিত হয় একমাত্র লাভ বা প্রফিটের দ্বারা , এইখানে নিয়ম নীতি , উচিত -অনুচিত , এথিকাল - নন এথিকালের বালাই নাই
২। এই মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেট গুলো অর্থনীতির লিগাল, ইলিগাল, সোসাল - সব কয়টা হাত কিনে নিয়ে নিয়ন্ত্রন করছে ।
অর্থাৎ , যেই কোম্পানি মানুষের পয়সা চুষে খেয়ে ফুলে ফেপে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে , সেই আবার কর্পোরেট সোসাল রেস্পন্সিবিলিটির নামে সোসাল ওয়ার্ক করে বেড়াচ্ছে ।
মানে , ধরুন আপনার কাছে একটা গরু আছে । ঐটা দিয়ে আপনি দুধ উৎপাদন করতেন , নিজে খাইতেন , পরিবারকে খাওয়াইতেন আর বাড়তিটুকু বিক্রি করে সংসার চালাইতেন। এখন আমি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আপনার কাছ থেকে অনেক টাকায় গরুটা কিনে নিলাম । এবং দুধ আপনার কাছে বিক্রি করা শুরু করলাম , আপনিও কিনতে বাধ্য কারন আপনার নিজের আর গরু নাই। আপনি টাকার লোভে গরু বিক্রি করে দিলেও কিছু দিন পরেই ভুলটা বুঝলেন, টাকা তো চিরদিন থাকে না, খরচ হয়ে যাচ্ছে , কিন্তু তখন আর কিছু করার নাই । আপনার পয়সা ফুরায় গেলে আমার কাছেই হাত পাতলেন । আমি আপনাকে আমার মালিকানাধীন গরু যেইটা আগে আপনার ছিলো সেইটা দেখা শোনার দায়িত্ব দিলাম এমন বেতনে যেইটা দিয়ে বাচ্চা কাচ্চা দূরে থাক , আপনার নিজেরই এক গ্লাস দুধ জুটে না । এইবার আমি আমার কর্পোরেট সোসাল রেস্পন্সিবিলিটির নামে আপনারে দুধ কিনার ঋণ দিলাম। সেইটা দিয়ে আপনি নিজের বাচ্চার জন্য দুধ কেনা শুরু করলেন। আপনাকে বিক্রির কমিশন দেওয়ার লোভ দেখালাম ও ক্রেতা বাড়াতে বললাম। অচিরেই আপনি বুঝতে পারলেন , আয় না বাড়ালে ঋণ শোধ করা যাচ্ছে না । বাচ্চার লেখা পড়া বন্ধ হয়ে গেছে । আর আশে পাশের বাড়িতে যতদিন দুধ আলা গাভী থাকবে , আপনার বিক্রি বাড়বে না । আমাকে আর কিছু করতে হইলো না । বাঁচার তাগিদে আপনি আশে পাশে লোকজনকে গাভী বিক্রির জন্য মূলামূলি শুরু করলেন। ইতমধ্যে আমার লাভের টাকা দিয়ে আমি একটি স্কুল খুললাম । আমার কাছ থেকে স্বল্পসুদে ঋণ নিয়ে সেইখানে বাচ্চা কাচ্চারে পড়াতে শুরু করলেন। সেইখানে আমি তাদের আমার সুবিধা মত উচিত, অনুচিত, ভ্যালু শিক্ষা দিলাম । কিন্তু দিনে দিনে খরচ বেড়েই চলেছে , শেষে ভিটা মাটি বন্ধক পড়লো আমার কাছে । স্বভাবতই , আমি মহান । তাই আপনার বউকে নিয়ে এলাম , ট্রেনিং দিলাম ও একটা মিষ্টির কারখানা বানিয়ে তাতে কাজে লাগালাম। আগে ২২ টাকা লিটারের দুধ আমি নিতাম ২০ টাকা । আপনার বেতন ছিল ২ টাকা । মিষ্টির কারখানায় দুধ বেচে এখন পান ৪ টাকা (কমিশন সহ) । বউ এর বেতন ২ টাকা ( যেহেতু মেয়ে) । মিষ্টির কেজি ১৪০ টাকার ১৩৬ টাকা আমার । ভুলে যাবেন না , আপনার ৬ টাকা থেকে আমাকে কিস্তি দিতে হয় কিন্তু । ধরে নেই , কিস্তি ২ টাকা । সেখান থেকে আমি রাখি ১ টাকা । বাকি ১ টাকা দেই আপনার ছেলেকে যে মাসে মাসে কিস্তির টাকা আমাকে এনে দেওয়ার কাজ নিয়েছে আমি যেই নতুন ব্যাংকটা খুলেছি সেইখানে। ইতমধ্যে আপনার মেয়ে স্কুল পাশ দিয়েছে । আমি তাকে ট্রেনিং দিয়ে পোল্ট্রির কাজে লাগিয়েছি যেইটা আপনার আগের ভিটায়/ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত । শিক্ষিত বলে তার বেতন আড়াই টাকা । চাইলে অবশ্য সে ঋণ নিয়ে আমার পোল্ট্রির মুরগীগুলাকে বেচার ব্যবসা করতেই পারে। এই রকম ভয়ানক পরিশ্রমের ফলে অসুখ বিসুখ হইতেই পারে । তাই আমি একটা হাসপাতাল দিয়েছি । সংস্থার কর্মী হিসেবে ঐখানে আপনি ৩০% ডিস্কাউন্টে চিকিৎসা পান। এর ভিতরে এলাকায় ইলেক্ট্রিসিটি নিয়ে এসেছি। আমার নতুন গার্মেন্টস আর বিড়ি সিগারেটের কারখানাইয় আপনার আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শীরা কাজ করে , যাদের গরু গুলোকে আপনিই তাদের প্রলব্ধ করেছিলেন আমার কাছে বেঁচে দিতে । এরাই আবার আমার মিষ্টি, কাপড় , বিড়ি, শিক্ষা , চিকিৎসা ইত্যাদির ক্রেতাও ।
এই গল্পটা থেকে ৩টা জিনিস শিখবেন ।
১। আপনার বেতন যতই বাড়ুক, আপনি কোনদিনই আমার মতন বড়লোক হইতে পারবেন না , আর ১৪ জেনারেশন ধরে চেষ্টা করেও পুরাপুরি ঋণ মুক্ত হইতে পারবেন না । শুভংকরের ফাঁকিটা ঐখানেই ।
২। আপনার বেতন আমি তখনই বাড়াব যখন আমার উৎপাদিত পণ্যের ক্রেতা বাড়ানোর জন্য একটা নির্দিষ্ট ক্রয় ক্ষমতা সম্পন্ন কনজিউমার বাজার লাগবে ।
৩। আগে আপনি ও আপনার আশে পাশের সবাই গরু নামক একটি উৎপাদক যন্ত্রের মালিক ছিলো । আজকে আমি হইলাম মালিক আর আপনারা সবাই আমার ইচ্ছার অধীন , উচ্চ বেতন সম্পন্ন , মাল্টিন্যাশনালে কর্মরত গর্বিত কর্মী । পাশাপাশি আমার ক্রেতা।আপনে যতই উপরে উঠেন, আমি মালিক, আপনি আমার চাকুরে/চাকর
এর নাম কর্পোরেট বাণিজ্য । আমি আপনাকে প্রতি পদে পদে ঠকাচ্ছি , ঠকিয়ে নিজে লাভ করছি । প্রথমে ঠকাচ্ছি বেশি দামে গরু বিক্রির লোভ দেখিয়ে ( অনেক বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন) , তারপর বেতনে , তারপর ঋণে , তারপর সুদে , তারপর ডিস্কাউন্ট দেওয়ার নামে উৎপাদিত পণ্যের বান্ধা কাস্টমার বানিয়ে , এবং পরিশেষে আপনাকে চিরদিনের জন্য ঋণে বেধে ফেলে ।
আপনার গরু , আপনার গরুর দুধ এখন একবার দুয়ানোর জন্য শ্রম দিবেন, তারপর কেনার জন্য শ্রম দেবেন , তারপর বেঁচার জন্য শ্রম দিবেন । সুতরাং, কইয়ের তেলে কইই শুধু ভাঁজছি না আমি , একটা মাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাঝে আমি আপনাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধাপে শোষন ও করছি ।
শুরুতে এই কর্পোরেট নামক শোষক যন্ত্রটি ছোটই থাকে । আস্তে আস্তে এরা গ্রাস করে নেয় খাদ্য , বস্ত্র, বাসস্থান , শিক্ষা , চিকিৎসা, বিনোদনের মত মৌল চাহিদা মেটানোর সব কয়টা উৎপাদনের উপকরণ ।
এখন এই গ্রাস তারা কেমনে সম্ভব করে? কিছু দিন আগেও প্রধান তরিকা ছিলো যুদ্ধের মাধ্যমে দখল ও সরাসরি শোষণ। যেমন, বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত শাসন। কিন্তু এতে দেখা গেলো দুই দিন পর পর, খালি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে দেয় ফাউল পোলাপাইন । এইবার নতুন তরিকা । সেই ম্যাট্রিক্স ছবিটার মতন সবাইরে ঘুম পাড়ায় রাখো । তুমি মনে করবা তুমি স্বাধীন , বাস্তবে স্বাধীন না । ঠিক এই কাজটাই এখনকার মাল্টিন্যাশনাল বিজনেস ওয়ার্ল্ড করে থাকে যার নাম মার্কেটিং ( আসলে ব্রেইন ওয়াশিং) । তা মার্কেটিং কাকে বলে ?
মার্কেটিং হলো সেই প্রক্রিয়া যা আপনাকে কিনতে বাধ্য করবে এমন একটা বস্তু যা আপনার কোন কালেই দরকার ছিলো না এবং অবশ্যই উৎপাদনের দশগুণ দামে ।
এখন এই মার্কেটিং এর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হইলো মিডিয়া । ২৪ ঘন্টা যেই মিডিয়া আমাদেরকে কিছু ভ্যালু বা মূল্যবোধ শিক্ষা দেয় । আপনারা হয়ত ভাবতে পারেন আপনার উপরে মিডিয়ার কোন প্রভাব নেই । কিন্তু মাথা ঠান্ডা করে খুব সূক্ষ ভাবে চিন্তা করলেই দেখবেন , আজকের মিডিয়া আমাদেরকে কি দেয়? তথ্য ? বিনোদন ? নাকি শিক্ষা ?
কোনটাই না ।
মিডিয়া আমাদেরকে দেয় অর্থ বা মিনিং । প্রতিটা মানুষেরই মূল তিনটা প্রশ্ন থাকে , আমি কে , আমি কি এবং আমি কেন ? আমরা বেশির ভাগই হন্যে হয়ে এই প্রশ্ন গুলার উত্তর খুঁজে বেড়াই আর মাল্টি কর্পোরেশনের মার্কেটিং বিভাগ ঠিক এই উত্তর গুলাই তাদের সুবিধামত আমাদের সামনে হাজির করে । লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতা এই কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের বাণিজ্যের সাথে এই ভাবেই জড়িত । তারা প্রতিনিয়ত ঠিক করে দিচ্ছে , বাংলাদেশের একজন নারী কে? কি এবং কেন ?
লাক্সের বিজ্ঞাপন অনুযায়ী ,
কে? - আমি একজন সুপারস্টার
কি? - অন্যদের চেয়ে অনেক অনেক উপরে, অনেক বেটার
কেন? - কারন আমি বিশেষ একটি ইমেজ যাপন করি
লক্ষ্য করে দেখুন, একটা মানুষের আত্মপরিচয়, অস্তিত্বের মাপ কাঠি এবং জীবন যাপনের উদ্দেশ্য বিধেয় লাক্স ঠিক করে দিচ্ছে । লাক্স আমাদের ব্রেইন ওয়াশ করে এইটা প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে যে একটি নির্দিষ্ট চেহারা , নির্দিষ্ট কিছু স্কিল (নাচ, ক্যাট ওয়াক, শপিং , দেহের মাপ ধরে রাখা ইত্যাদি) আমাদেরকে মানুষ হিসেবে অন্যদের চেয়ে বেশি দামী করে তুলবে । এবং আমরা তখন সুপারস্টার হয়ে যাব । আর সুপার স্টার হলেই আমরা মানুষের ভালোবাসা , সম্মান, প্রতিষ্ঠা , সাফল্য পাব। সেই সাফল্যের সংজ্ঞা , সেই ভালোবাসা পাওয়ার তরিকা বাতলে দিতে পারে কেবল লাক্স আর চ্যানেল আই।
আমাদের , বাংলাদেশের ২০০০ বছরের সংস্কৃতি , প্রাচ্যের দর্শন , জীবন বোধ কি বলে? আমরা কি সাফল্যের এই সংজ্ঞায় অভ্যস্ত? আমাদের হাজার বছরের জীবন ভাবনা আমাদের এতদিন শিখিয়েছে ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। মাত্র দুটি কাপড়েই জীবন ভালো ভাবে চলে যেতে পারে। অল্প খাও কিন্তু খাঁটি খাও । কিছুদিন আগে পর্যন্তও বেশি শুকনা মেয়েদের বিয়ের সমস্যা হইত কারন আমরা একটু স্বাস্থ্যবতী বউ পছন্দ করতাম। সৌন্দর্য্যের মাপ ছিল সাদামাটা টানা টানা কাজল কালো চোখ আর খোঁপায় বেলী ফুলের মালা। টিভি মিডিয়ার বদৌলতে আমরাও শুকনা ভালোবাসতে শিখেছি । এখন ক্যাট্রিনা হইলো আদর্শ । আমাদের ভ্যালু বদলাচ্ছে । আমরা চাই আর না-ই চাই , আমাদের আদর্শ বদলে যাচ্ছে । শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বের মানুষের মাথায় হাতুড়ি পিটা করে শিখানো হচ্ছে , ক্যাটরিনা মানে সাফল্য , ক্যাটরিনা মানে আদর্শ । যার সব টুকুই মিথ্যা আর ভয়াবহ রকমের প্রেজুডিসড, রেসিস্ট , পাশবিক।
এখন প্রশ্ন হইলো সারাজীবন মাল্টিন্যাশনালে চাকরী করে আমরা সবাই কি মাল্টিন্যাশনালের মালিক হইতে পারবো ?
সারা জীবন লাক্স , চ্যানেল আই এর সাথে গা ঘষাঘষি করলেই কি আমরা সবাই সুপারস্টার হইতে পারবো?
এখন এই -গ্ল্যামারই জীবনের সাফল্যের মাপকাঠি- ধরনের ব্রেইন ওয়াশে দর্শকের দেহকামনা , ধর্ষকামী ভূতের আছর আসলো কেন? এদের ভূমিকাই বা কি?
পড়ুন ৩য় পর্ব ।
১ম ও ২য় পর্ব থেকে যদি সার সংক্ষেপ কিছু নিতে চান তাহলে নিচের উপলব্ধি গুলো গুরুত্বপূর্ণ ।
১। আজকের বিশ্বে কর্পোরেট দুনিয়া আমরা কি খাব, কি পরবো, কি রকম বাড়িতে বাস করবো, কি ধরনের মূল্যবোধকে দাম দেব, কিসে বিনোদিত হবো , কাকে বিয়ে করবো , কোন অবস্থানকে জীবনের সাফল্য আর কোনটাকে জীবনের ব্যর্থতা হিসেবে মানবো - এই সব কিছুই ঠিক করে দেয় । ( কারন, একই মালিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , সেবা খাত আর পলিটিকাল দলকে চালায়)
২। এই কর্পোরেট দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হইলো মিডিয়া । বিশেষ করে মাল্টি মিডিয়া যা প্রতিনয়ত এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর সুবিধা ও লাভ অনুযায়ী আমাদের ভ্যালু সিস্টেম ( কিসের মূল্য কত টুকু) , আমাদের কালচার, আমাদের জীবন দর্শনকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে । যা কিছু ব্যবসার সহায়ক তাকে উৎসাহ দিচ্ছে , যা কিছু ব্যবসার পথে প্রতিবন্ধক তাকে খারাপ বলে শিক্ষা দিচ্ছে ।
৩। এইটা করাটা খুব বেশি জরুরী কারন মানুষ যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করা শুরু করলেই এই দানব মাল্টিন্যাশনাল গুলা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে । আরো একটা কারণে এই মিডিয়ার প্রচার প্রয়োজন কারণ , পুঁজিবাদ বেঁচে থাকার জন্য একটা কাজ প্রতিনিয়ত করে তা হলো প্রফিট । অর্থাৎ , প্রফিট বা লাভ ছাড়া পুঁজিবাদী মার্কেটিং সিস্টেম বাঁচতে পারে না । এইটা কোন সেলফ সাস্টেইনেবল সিস্টেম না বরং সেলফ ডিস্ট্রাক্টিভ সিস্টেম। ক্রমাগত বাড়তে না পারলে পুঁজিবাদী মার্কেট ভেঙে পড়ে ।
একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝাই । আগের পোস্টের গরুটাকে মনে আছে ? ওই যে , লাভ করার জন্য আপনি পাড়াপ্রতিবেশীকে গাভী বেচে দেওয়ার জন্য ছল, বল ও কৌশল ব্যবহার করলেন? এখন এই পুরা উৎপাদন প্রক্রিয়াটিতে কর্পোরেট পুঁজিবাদ লাভ করে দুই ভাবে । এক হলো , শোষন ( শ্রম শোষণ) , আর ২য় হল উৎপাদনের বেশি দামে বিক্রি ।
কর্পোরেট বাণিজ্য-তে আপনার গরু (ছিলো), আপনার গরুর দুধ এখন একবার দুয়ানোর জন্য ( আমি কিনে নেওয়ার পর) শ্রম দিবেন, তারপর কেনার জন্য শ্রম দেবেন , তারপর বেঁচার জন্য শ্রম দিবেন । সুতরাং, কইয়ের তেলে কই-ই শুধু ভাঁজছি না আমি , একটা মাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাঝে আমি আপনাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধাপে শোষনও করছি ।
২য় পদ্ধতিতে লাভ করতে হলে চাই বিক্রি । বিক্রি করতে হলে চাই ডিমান্ড । ডিমান্ড ক্রিয়েট করতে হলে চাই নতুন নতুন বাজার বা কঞ্জিউমার / ক্রেতা। মানে, বাজারে সকল ক্রেতার কাছেই যদি দুধ থাকে তাহলে আমার দুধ আর বিক্রি হবে না । সুতরাং হয় আমাকে,
১। সকলের দুধ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে (স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ডিমান্ড তৈরী)
২। নাইলে নতুন ক্রেতা খুঁজে নিতে হবে ( নতুন ক্রেতা মানে নতুন ডিমান্ড)
৩। বা মানুষের দরকার থাকুক আর নাই থাকুক , ক্রেতাকে দিয়ে যে কোন মূল্যে দুধ কেনাতে হবে । ( কৃত্রিম ডিমান্ড বা মিথ্যা ডিমান্ড তৈরী)
আমাদের লাক্স কিংবা চ্যানেল আই বাঁচে এই ৩য় প্রকার ডিমান্ড তৈরী করার মধ্য দিয়ে । প্রসাধন জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় না । যেমন জরুরী না টিভি দেখা । এমন কি খাদ্য কিংবা জীবন্রক্ষাকারী ওষুধ এর মত জরুরী পণ্য হলেও যদি তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে উৎপাদিত হয় (মার্কেট স্যাচুরেশন করে ফেলে, যেমন পানিতে লবণ ঢালতে ঢালতে এক সময় যখন পানি আর লবণ নিতে পারে না) অথবা দাম বেশি বলে ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন কর্পোরেট পুঁজিকে দৌড়াতে হয় নতুন ক্রেতা ধরতে - থাকলে খুঁজে নাও , না থাকলে বানাও ।
বিল গেটস শিক্ষা দীক্ষা নিয়ে আকুল হইতেন না; যদি না কম্পিউটার কেনার জন্য এবং ব্যবহারের জন্য একটা নির্দিষ্ট লেভেলের শিক্ষা, দরকার না হইত ।
এখন পৃথিবীর সকল জায়গায় কোন দুইটা জিনিসের ডিমান্ড চিরকাল থাকবে , যতদিন মানুষ থাকবে , ততদিন থাকবে?
১। খাদ্য । যেইখানেই জীবন থাকবে সেইখানেই ক্ষুধা থাকবে।
২। সেক্স । যেইখানেই মানুষ থাকবে , সেইখানেই সেক্স থাকবেই ।
লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার এই দ্বিতীয় বাজারটির কারবারী । কি করতে হবে? সুন্দর হইতে হবে । কেন সুন্দর হইতে হবে? সুন্দর হইলে সুপারস্টার হওয়া যাবে । কেন সুপারস্টার হইতে হবে? সুপারস্টার হইলে সেক্সের বাজারে দাম বাড়বে ( সেই সেক্স বিবাহের বাইরেই হোক আর ভিতরে ) । এর সাথে আনুসাঙ্গিক হিসেবে টাকা, প্রভাব, খ্যাতি - কে না চায় এই সব?
কি ভাবে মিথ্যা ডিমান্ড তৈরী করে টিভি মিডিয়া ?
আমাদের চাওয়া এবং প্রয়োজনের বোধকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে দিয়ে।
হাত ধোয়ার সাবানের মার্কেট শেষ । তাইলে সাবান এখন কেন দরকার? সুন্দর হওয়ার জন্য । শীত বা গরম ও লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য যতটুকু কাপড় মানুষ এর দরকার হয় , এখন তার চেয়ে অনেক বেশি কাপড় উৎপাদিত হয় । তাই কি দরকার ? ফ্যাশন । বিউটি সোপ আর ফ্যাশনেবল কাপড় এ বাজার ছেয়ে গেছে । তাইলে এখন কি দরকার ? এখন দরকার সুপারস্টার হওয়া ।
আসেন দেখি কর্পোরেট পুঁজিবাদ ইউনিলিভার কি ভাবে এই ফলস ডিমান্ড তৈরী করে?
বিশ্ব ব্যাপী সুন্দরের যেই সংঙ্গা কর্পোরেট গুলা তৈরী করেছে , তার মূলে আছে মানুষের অদম্য কামনা । যা মানুষ হতে পারবে না কোন দিন -তাকেই আদর্শ হিসেবে সেট করে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মিডিয়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে । কি রকম?
১। আফ্রিকা ও এশিয়ার উপমহাদেশে সারাক্ষণ প্রচার হচ্ছে ফর্সা হউন।
ইউরোপ ও আমেরিকায় সারাক্ষণ প্রচার হচ্ছে , কালো (ট্যান) হউন।
২। কালো চুলের মেয়েদের সারাক্ষণ দেখানো হচ্ছে , কালোদের স্ট্রেইট চুলে বেশি ভালো লাগে। আর যাদের চুল এম্নিতেই স্ট্রেইট , সেই সাদাদের দেখানো হচ্ছে কোকড়া চুল বেশি সেক্সি ।
৩। শুকনা মেয়েদের - তোমার বড় বুক নেই । মোটা মেয়েদের - তোমার চিকন কোমর নেই।
৪। খাট পুরুষদের - লম্বা হউন। লম্বা পুরুষদের - মাস্কুলার হউন। মাস্কুলার পুরুষদের - যৌণ শক্তি বাড়ান।
মানে , আপনি ফর্সা, কালো, খাট - লম্বা, চিকন - মোটা - যাই হোন না কেন , আপনার শান্তি নাই । আপনি কিছুতেই সেক্সের যোগ্য না । প্রেমের যোগ্য না। ভালোবাসার যোগ্য না। সম্মানের যোগ্য না । আপনি কিছুতেই সফল না না না না না, যতক্ষণ না তাদের পণ্যটি ব্যবহার করছেন । আমি যতই বলি আপনি পারফেক্ট , আপনি বিশ্বাস করবেন না , কারণ মিডিয়া আপনাকে সারাক্ষণ শিখাচ্ছে , আপনি পারফেক্ট নন। ইউ নিড মোর । মোর মানি।মোর সেক্স । মোর মোর মোর ।
এই ঝামেলায় কি খালি মেয়েরাই? নাহ। নিঃসন্দেহে মেয়েরা তাদের দেহ এবং রুপ দিয়ে বিচার্য হয় বলে ৯০% টার্গেট মেয়েদের শরীর । ত্বক, বুক, নিতম্ব, মুখমন্ডল - আমাদের সমস্যার অন্ত নেই আর কোম্পানি গুলার সমাধানেরও অন্ত নেই । কিন্তু ছেলেরাও কম ঝামেলায় নেই । ৪২ ইঞ্চি ছাতি , ব্র্যাড পিটের নিতম্ব আর সিক্স প্যাক না হইলে চলবে না । এদিকে আবার দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী পুরুষ গুলা সব ভুড়িয়াল , তাতে কি? সব কয়টা নোবেল প্রাইজ উইনারও অতি সাধারন দেখতে, তাতে কি? অবশ্য পুরুষের সাফল্য মানে সাধারণত দেহ নয়, কাড়ি কাড়ি টাকা । সোজা ভাষায় যা আপনি হইতে পারবেন না ( বায়োলজি, ইকোনমি কিংবা সোসাল কারনে), তা হইতে উদ্বুদ্ধ করাটাই হইলো মার্কেটিং , ব্রেইন ওয়াশিং এর কাজ ।
অতএব লাক্স এবং চ্যানেল আই এর কাজ হইলো বঙ্গবাসীকে আগে এইটা শিখানো ,
হোয়াট ইজ সেক্সি? ( উত্তর অতি অবশ্যই লাক্স সুন্দরী। এইটা তো লাল সালুর ব্লগে প্রমান হয়েই গেছে যে লাক্স এই কাজে পুরাপুরি সফল হয়েছে )
এই জন্য চোখ , ঠোঁট আর ভঙ্গিমায় আবেদন খুঁজে বেড়াইলেন আমাদের দাদু শামসুল হক ।
পরের ধাপ হইলো ,
হু ইজ সেক্সি ? ( উত্তর অতি অবশ্যই যারা লাক্স সুন্দরীদের মত দেখতে, চলনে, বলনে ইত্যাদি । এইখানেও তারা সফল)
এর পরের ধাপ, মানে আসল ধাপ , আপনি কিভাবে সেক্সি হবেন? ( লাক্স , জগৎজোড়া বিখ্যাত কোম্পানির প্রসাধন ব্যবহার করতে হবে )
প্রথম পোস্টের কথা মনে আছে ? ঐ যে বলেছিলাম , একই কর্পোরেট অঙ্গের বিভিন্ন ব্যবসার হাত? মিমি কাপড়ের ব্যবসা, সুবর্ণা এ্যাড মেকার , শামসুল হক চিত্রনাট্য লেখক । তাহসিন, ইষানা , মেহজাবিনরা পণ্য নন , পণ্যের বিক্রেতা । এরা একই কর্পোরেট বাণিজ্যের এক একটি অনুসঙ্গ । সকলেই একটি মাত্র উৎপাদন থেকে বিক্রি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত !
দর্শকদের দেহ কামনাঃ
আগেই বলেছি , যেখানেই মানুষ থাকবে সেইখানেই সেক্স থাকবে। হয় প্রকাশ্যে নয় গোপনে। এইটা মানুষের মৌলিক চাহিদা । এর ডিমান্ডের শেষ নাই । তাই সাপ্লাইএর ও শেষ নাই। যারা " মা বোনেরা বেশ্যা হয়ে গেলো " বলে বোল তুলেছে তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, ২০০০ বছর আগেও বঙ্গে বেশ্যালয় ছিল। তখন লাক্স চ্যানেল আই ছিলো না । কিন্তু আমার-আপনার বাপ, ভাইয়েরা ছিলো বলে ডিমান্ড ছিলো । তাই সাপ্লাইও ছিলো । ইট ইজ দ্যাট সিম্পল। লাক্স চ্যানেল আই ডিমান্ড তৈরী করছে না । তৈরী হয়ে থাকা ডিমান্ড নিয়ে ব্যবসা করছে শুধু ।
সেক্স হলো বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্য । হয় সেক্স , না হয় সেক্সুয়ালিটি। ৪ বিলিওন মানুষ এর ক্রেতা অথবা বিক্রেতা ( এক তৃতীয়াংশ মানুষকে শিশু ধরে নিয়ে বাদ দিলাম) সারা বিশ্ব জুড়ে । তাহলে বুঝেন এর ডিমান্ড কেমন?
লাক্স, ইউনি লিভার এর নতুন করে ডিমান্ড তৈরী করার দরকারই নাই , দরকার শুধু এই ডিমান্ডের সাথে তাদের পণ্য গুলাকে এলাইন করা , আমাদের বুঝানো যে তাহাদের পণ্য , মাখিলেই বন্য!
তার মানে কি তারা নারীকে পণ্য করছে না? অবশ্যই করছে । শুধু নারী কেন, তারা পুরুষ ও বাচ্চাদেরও পণ্য করছে । কেন খেয়াল করেন নাই? ২০০০ বছরে হয় নাই , আজ কাল হঠাৎ করেই বাচ্চাদের ত্বক শুষ্ক আর খসখসে হয়ে উঠেছে ? যেই দিন থেকে লাক্স বেবি লোশন ক্রিম নিয়ে মাঠে নেমেছে সেইদিন থেকে আমাদের শিশুরা ত্বকের আর্দ্রতা হারাচ্ছে ?
আগেই বলেছি , নতুন ক্রেতার বাজার তৈরী করতে না পারলে এই সর্বগ্রাসী প্রফিট ওরিয়েন্টেড কর্পোরেট পুঁজিবাদ বেঁচে থাকতে পারে না । মা বোনের , কিশোর কিশোরীদের মার্কেট স্যাচুরেটেড হয়ে গেছে , এখন তাই বাচ্চার চামড়া দরকার , ব্যবসার জন্য !
আমি খুবই দুঃখিত, এই পর্বেও শেষ করতে পারলাম না । পরের পর্বে আশা করি শেষ করতে পারবো ।
পড়ুন শেষ পর্ব ।
আগের পর্ব গুলা থেকে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে,
১। যেই কর্পোরেট বাণিজ্য গুলাকে আমরা ভিন্ন ভিন্ন সেক্টর , ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা বলে মানি , সেই গুলো হতেই পারে একই বাণিজ্যিক মালিকের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা (গরু কাহিনী)। আর যদি তা নাও হয় , তারপরেও তারা একই প্রোডাকশন লাইনের ( এন্টারটেইন্মেন্ট মিডিয়া) বিভিন্ন পর্যায়ে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এবং সার্ভাইভালের জন্য একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল। অর্থাৎ , মিমির কাপড়ের ব্যবসা সুবর্ণার নাটকের উপর , সুবর্নার নাটক হকের লেখার উপর, হকের নাটকের প্রচার ইউনিলিভারের বিজ্ঞাপনের উপর, ইউনিলিভারের বিজ্ঞাপন ফুয়াদের জিঙ্গেলের উপর , ফুয়াদের জিঙ্গেল পণ্যের মডেলের উপর এবং পণ্যের মডেল দর্শকের সেক্স ও সেক্সুয়ালিটির উপরে নির্ভরশীল। এই সম্পর্কটি লিনিয়ার নয় বরং মাকড়সার জালের মত ইন্টারকানেক্টেড।
২। এনটারটেইনমেন্ট মিডিয়ার কর্পোরেট দুনিয়া নিজেদের এবং পৃষ্ঠপোষক ( এবং শোষক) ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাভের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রতিনয়ত এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলার সুবিধা ও লাভ অনুযায়ী আমাদের ভ্যালু সিস্টেম ( জীবনের কোন জিনিস, কোন শিক্ষা , কোন অনুভূতি সবচেয়ে মূল্যবান , তুলনামূলক ভাবে কিসের মূল্য কত টুকু) , আমাদের কালচার, আমাদের জীবন দর্শনকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করে। যা কিছু ব্যবসার সহায়ক তাকে উৎসাহ আর যা কিছু ব্যবসার পথে প্রতিবন্ধক তাকে খারাপ বলে শিক্ষা ব্রেইন ওয়াশ করতে থাকে।
৩। এইটা করাটা খুব বেশি জরুরী কারন মানুষ যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করা শুরু করলেই এই দানব মাল্টিন্যাশনাল গুলা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে ।
গরু কাহিনীতে ফেরত যাই । মনে করুন, হঠাৎ একদিন আপনার প্রতিবেশীরা ঘুম থেকে জেগেই উপলব্ধি করলেন , তাদের গরুগুলো ( উৎপাদনের যন্ত্র ) যেদিন থেকে হাতছাড়া হয়েছে , সেদিন থেকেই তারা আমার দাসানুদাস হতে শুরু করেছেন। এই উপলব্ধি হলে তারা কি আমাকে ছেড়ে কথা বলবেন ? আন্দোলন করে ফাটিয়ে দেবেন না ?
নাহ ।
ভুলে গেছেন , আমার কাছে গরু বেচতে আমি বলিনি , বলেছেন আপনি ! একটু অনুসন্ধান করে এই সত্যও বের করা কঠিন না যে নিজের দুধের বিক্রি বাড়ানোর জন্যই আপনি এই ছলের আশ্রয় নিয়েছিলেন । ফলে মানুষ লাঠি নিয়ে পিটা লাগাবে আপনাকে । আর আমি? আমার কিছুই হবে না । এলাকায় স্কুল, হাসপাতাল, ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকারী আমি প্রেস কনফারেন্স করবো , " এই দেশের কোন এবিলিটি নাই। পলিটিকাল স্ট্যাবিলিটি নাই। আমি চললাম মালয়শিয়া , ওরা আমার মুসলিম ভাই !" দেশের একজন বিশিষ্ট ইনভেস্টরকে তাড়ানোর জন্য আপনি ও আপনার প্রতিবেশীরা পিটা খাবেন এরপর । দয়া পরবশ হয়ে আমি ব্যবসা গুটিয়ে ( বিক্রি করে) চলে যাওয়ার আগে সেই বুড়া গরুগুলিকে
১০ গুণ দামে আপনাদের কাছেই বিক্রি করে দিব , আন্দোলন থেমে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে । আমি মহান রয়ে যাব। ( গরুর জায়গায় কৃষি জমি কিংবা অন্য যে কোন উৎপাদন্মুখী খাতকে বসিয়ে নিতে পারেন। )
এখন কথা হইলো , এই হঠাৎ করে জাগার কারন কি? মালয়শিয়া যদি বুঝে আপনারে খেপাইলে ব্যবসা তার দ্বারে যাবে তাইলে মালয়রা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে আপনার জ্ঞানচক্ষু খুলার জন্য " দা ইভিল অফ ক্যাপিটালিজম" ক্লাস নিবে। তবে , আপনি আমার কাছে গরু বিক্রির আগে না , অবশ্যই পরে।
যে সময়টা জেগে উঠলে আপনার লাভ , সেই সময়ে চক্ষু খুলার একটাই উপায়, তা হলো শিক্ষা ও জ্ঞানের চর্চা। সারা দুনিয়া জুড়ে কে কি কেন করছে , সেই পলিটিকাল জ্ঞান থাকা। স্বচ্ছ ও অবাধ তথ্যের আদান প্রদান ও সেই তথ্যের মিনিং বুঝার জ্ঞান । আমেরিকা ইরাক আক্রমন করেছে - এইটা তথ্য । আমেরিকা ইরাক থেকে তেল নিবে বলে আক্রমন করেছে হইলো জ্ঞান । আর তেলের পাইপ লাইন টানার জন্য আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে ডিক্টেটরশীপ গুলাকে পয়সা দিয়ে পালছে- এইটা হইলো মিনিং । আমি মালয়শিয়া পালানোর আগেই আমাকে ধরতে হলে কিংবা ঠেকাতে হলে এই মিনিংটা বুঝতে হবে ।
লাল সালুর আক্রমনের টার্গেট মেয়ে গুলা , বড় জোর বিচারক । তার পিছনে চ্যানেল আই না । চ্যানেল আই এর পিছনে লাক্স না। লাক্সের পিছনে ইউনিলিভার না। আগেই বলেছি , লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার জাতীয় প্রতিযোগিতা গুলো সেক্সের ডিমান্ড তৈরী করে না । যে ডিমান্ড সমাজে তৈরী হয়েই আছে , অত্যন্ত সুস্থ এবং স্বাভাবিক জৈব চাহিদা হিসেবেই আছে , তাকে ব্যবসার খাতিরে ব্যবহার করে, উস্কে দেয় । ছেলেদের ধরে ধরে সুড়সুড়ি দেওয়াই যে এর মূল উদ্দেশ্য ঠিক তা না , তবে অস্থির করলে এই বেনিয়াদেরই লাভ। পণ্য বিক্রি ও পণ্যের বিপণণ আসল উদ্দেশ্য হইলেও সমাজকে বিশেষ করে তরুন সমাজকে অস্থির করে রাখলে এই বেনিয়াদের যেই লাভটা হয় তা হলো , অস্থির মানুষ চিন্তা ভাবনা করে কম। ক্রিয়া করে কম, করলেও সেইটা রতিক্রিয়াই হবে, তবে রতিক্রিয়ার চেয়েও অনেক বেশি করে প্রতিক্রিয়া। কোন কিছু নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করতে চাইলে চাই শান্ত মন। সুস্থির বিবেক। চাই যুক্তি ও জ্ঞানের সঠিক সম্মেলন। কিন্তু এই সুড়সুড়ি মার্কা প্রতিযোগিতাতে অস্থির যুবকরা অস্থির হয়ে উঠে তাদের প্রতিবাদের ভদ্র ভাষাটাও ভুলে যায় । লাল সালুর ব্লগ পোস্টে তার স্পষ্ট প্রমান আছে । অস্থির , অসংলগ্ন মানুষকে প্রভাবিত করা বা ব্রেইন ওয়াশ করা অনেক সোজা। সুতরাং তুমি লাক্স কেনো আর নাই কেনো , মানুষ যত অস্থির , তত প্রতিক্রিয়াশীল, যত প্রতিক্রিয়াশীল তত দুর্বল , যত দুর্বল ততই সহজ তার কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রন করা ।
এই জন্যই সুস্থির , চিন্তাশীল সমাজ ও সামাজিক জীবন পুঁজিবাদের পছন্দ না । পুঁজিবাদের চাই অস্থির গতি , আরো আরো আরো গতি ! মানুষ সারাক্ষণ ছুটবে । হয় রোজগার নেই বলে ছুটবে , নয়ত রোজগার আছে বলে ছুটবে। আর খাবে । কামাবে আর খরচ করবে। মুখ দিয়ে খাবে । চোখ দিয়ে খাবে । মন দিয়ে খাবে। স্পর্শে খাবে, গন্ধে খাবে , চিন্তা চেতনায় খাবে । এই গ্রহন গুলো থেকে সে কিছু অর্জন করবে না , স্রেফ হজম করবে । কিছুই চিন্তা করবে না , পাগলের মত চ্যানেল ঘুরাবে , ছাগলের মত ফাস্ট ফুড চিবাবে , উঠতে বসতে ছটফট করে বেড়াবে - তাইলেই লাভ, লাভই লাভ!
চিন্তাশীল মানুষ নিজের বিপদ টের পায় সবার আগে । অস্থির মানুষ টের পায় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। এখন তাই ফাস্ট এর জয় জয়কার সারা মিডিয়া জুড়ে । শিল্পী ( স্লো পদ্ধতি ) চাই না, স্টার (ফাস্ট) চাই। ফাস্ট ফুড , ফাস্ট সেক্স , ফাস্ট লাইফ !
কারন যেই মুহুর্তে আপনি চিন্তা করতে শুরু করবেন , আরেকটা সিম কেন কিনবো? কি লাভ? আরেকটা গাড়ি কেন লাগবে? ইষানা কেন, কুলসুমও তো সুন্দরী ! ৮০০ টাকা দিয়ে চিকেন ফ্রাই কেন খাব , বাসাতে ১২০ টাকা দিয়ে নিজেই বানাতে পারি তো! ক্যাটস আই এর শার্ট লাগবে কেন? শার্ট তো শার্টই ! - সেই মুহুর্ত থেকে আপনি পুঁজিবাদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠলেন ।
পুঁজিবাদ চিন্তাবিদ চায় না। চায় ক্রেতা । যে খালি কিনবে আর কিনবে । আসলেই দরকার আছে না নাই, এই সব ভাববে না । তাকে শেখানো যাবে - বিজ্ঞাপন বলেছে দরকার , তাই দরকার!
পুঁজিবাদের সবচাইতে বড় শত্রু তাই কমিউনিজম নয় , সোসালিজম নয় । পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় শত্রু সচেতন , চিন্তাশীল মানুষ যা তাকে যুক্তিবাদ ও র্যাশনাল কেনা বেচা লেন দেন শিখায় । পুঁজিবাদের বড় শত্রু প্রাচ্যের জীবন দর্শন যা মানুষকে নির্লোভ ও আত্মত্যাগী ও সংযম শিক্ষা দেয় । যা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় , অন্যের ক্ষতি করে নিজে লাভবান হওয়াটা লাভ নয়, ক্ষতি । ঠিক একই কারণে পুঁজিবাদ এর বড় শত্রু ইসলাম । কারন, ইসলাম বলে দুনিয়াতে এত কেনাকাটার দরকার নাই , আখিরাতেই সব কিছু পাবা । ( আরব আমিরাতের ইসলাম না , আমাদের উপমহাদেশের সুফিবাদী , আত্মত্যাগী , নির্লোভ ও অল্পে সন্তুষ্ট জীবন দর্শন ধারী ইসলাম যেই দর্শনের দেখা পাওয়া যায় উপমহাদেশের হিন্দু ও বৌদ্ধ বিশ্বাসেও। ) পরকালের সুখের জন্য ইহকালে ত্যাগী জীবনযাপন করাটা পুঁজিবাদী বাণিজ্যের জন্য বিশেষ অপকারী ।
ঠিক এই কারণেই বাংলাদেশে ইদানিং মিডিয়া বিস্ফোরন ঘটেছে । একের পর এক প্রিন্ট , টিভি মিডিয়া আসছে । জনগণের উন্নতির জন্য আসছে ? নাহ । বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া তথা উপমহাদেশের জীবন দর্শন , যাতে ভোগের বদলে ত্যাগ , উপভোগের বদলে উপলব্ধি আর ইন্দ্রিয় সুখের বদলে ইবাদতের কথা বলা হয়েছে । এই দেড় বিলিওন ক্রেতার মন মানসিকতা চেঞ্জ করে পুঁজিবাদ নামক নতুন ধর্ম শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এই মিডিয়া এসেছে এবং মাল্টিন্যাশনাল গুলা এদের পেছনে এত টাকা ঢালছে । কালচারাল ও পলিটিকাল মূল্যবোধ , ধ্যান ধারনা বদলে মুনাফালোভী করে তোলা , পণ্যের প্রচার ও নতুন ধর্মে ( পুঁজিবাদ) দীক্ষা দেওয়ার জন্য এই এনটারটেইনমেন্ট মিডিয়ার কোন জুড়ি নেই। আমেরিকা , ইউরোপ জয় করে পরীক্ষীত ও সফল অস্ত্র হিসেবে এটি প্রচার হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশে । সুন্দরী প্রতিযোগিতা , ফুয়াদের সেক্সি গান আর লস প্রজেক্ট মার্কা ফারুকী বর্জ্য এই বিপুল " ব্রেইন ওয়াশ " কার্যক্রমের অংশ মাত্র!
অস্থির করার পাশাপাশি ছেলেদের মনের ভিতর কিছু নির্দিষ্ট ইমেজ তৈরী করাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্রেইন ওয়াশ । আমরা বুঝি আর নাই বুঝি , অবচেতন মনে আমরা প্রতিনিয়ত শিখছি , সুন্দর মানে মেহজাবিন। সুন্দর মানে ইষানা। সুন্দর মানে অর্ষা । আমরা যখন সুন্দরকে খুঁজবো , এই রকমই খুঁজবো। পার্থক্য শুধু তারা আমার সামনে ছাড়া আর কারো সামনে কাপড় খুলবে না । ওরাও মডেলই হবে , ভদ্র মডেল ।
এইটা আরো ভয়ংকর। ভয়ংকর এই কারণে যে একটি নির্দিষ্ট মাপ কাঠির বাইরের সবাইকে আমরা " অনাকর্ষনীয় " আখ্যা দিয়ে ফেলছি। আমরা নারী মাত্রেই শরীর বানিয়ে ফেলছি। নারীও মানুষ, অনুভূতি, মগজ সম্পন্ন - সেই বোধ হারিয়ে যাচ্ছে । আমরা বিদূষী বাদ দিয়ে বিদিশা খুঁজছি এখন ক্রমাগত । মানুষ হয়ে যাচ্ছে পদার্থ ।
এই পরিবর্তন , এই ব্রেইন ওয়াশ কতখানি সফল তার একটা উদাহরণ দেই -
প্রথম দিকের কোন পর্বে একটা মেয়ে দুর্দান্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলো , অথচ এই মেয়েদের কোন ট্যালেন্ট পর্ব আমি পাইনি খুঁজে। নিশ্চয়ই অন্য মেয়েরাও এই রকম কিছু না কিছু প্রতিভা নিয়ে এসেছিলো , কিন্তু মাংসের কারবারী ঐদিকে নজর দেয় নাই। যেই মেয়েটা " সবাই ভালো বলেছে তাই আমি কিনেছি" ধরনের প্যাসিভ বক্তব্য দিয়েছিলো , সে বাদ পড়েছে । এইটা একটা ভালো দিক যে একটা মানুষ যার নিজস্ব মতামত বলতে কিছু নাই , তাকে সাথে সাথে বাদ দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট বাজেট ও সময়ে কি করে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হয় , এইটা আমাদের সরকারী প্রোকিউরমেন্টের লোক জনও জানে না । জানাটা জরুরী । কিভাবে ক্লু দেখে রহস্যভেদ করতে হয় , কি ভাবে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয় - এই গুলা খুবই জরুরী গুণ । আমি নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি , ট্রেনিং ক্যাম্পের শিক্ষা গুলা যদি বাদ পড়া মেয়েরা নিজেদের জীবনে ধরে রাখতে পারে ( ভোর পাঁচটায় উঠে শরীর চর্চা আমারে দিয়াও হয় না) তাহলে তাদের উপকারই হবে । সঠিক নিউট্রিশন এবং ফিটনেস মানুষের অনেক বড় সম্পদ । এতগুলা ভালো ভালো দিক চোখে পড়ার পরেও আমি এই প্রতিযোগিতার পক্ষ নিতে পারছি না ।
কেন?
কারণ, সহজাত ভাবেই এই প্রতিযোগিতা যেই কর্পোরেট পুঁজিবাদিতার মন মানসিকতাকে উৎসাহ দেয় , যেভাবে একটা মানুষকে মানুষ থেকে বদলে শরীর সর্বস্ব অব্জেক্ট বানায় , যেভাবে শেখায় তারা ছাড়া বাকি সব অসুন্দর , সুপারস্টার না হলে জীবন ব্যর্থ - এই সব ঘৃণ্য শিক্ষা , মূল্যবোধের অবক্ষয় আর মানুষ না হয়ে ক্রেতা হওয়ার এই ইঁদুর দৌড়কে কোন ভাবেই সমর্থন করা যায় না ।
লাক্স প্রতিযোগিতায় অনেক কিছুই ছিলো , কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে শরীরটাকেই ফোকাসে রাখা হয়েছে , সব সময় ।
সবচাইতে বড় কারন ঃ
কর্পোরেট পুঁজিবাদিতার সব কিছুই ভন্ডামি আর মিথ্যাচারে ভরপুর
কি ভাবে কর্পোরেট পুঁজিবাদ আপনাকে ঘোরের ভিতরে আচ্ছন্ন করে রাখে? তাদের এই শরীর পূজাও এক বিশাল ফাঁকি !
জেনেটিক সাইন্স বলে একটা মানুষ কতটুকু লম্বা , মোটা কিংবা সুন্দর হবে তা নির্ভর করে জেনেটিক্স এর উপর । ক্রিম , সাবান , লতা পাতা ঘষে এইটার খুব একটা পরিবর্তন করা যায় না। ত্বক ফর্সা করার প্রতিটা ক্রিম ভুয়া । স্রেফ মিথ্যা । ত্বকের মেলানিন বেশি হলে আপনি কালো হবেন , মেলানিন কম হলে ফর্সা হবেন । ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমে ভয়াবহ ক্ষতিকারক কেমিকেলস থাকে।
সুন্দর ফিগারের একমাত্র উপায় হইলো খাদ্যাভাস আর শরীর চর্চা। তারপরেও মানুষের শরীর এর মাপ তিন রকম। তবে কাটায় কাটায় তিন আলাদা রকম না । মিক্সড ও আছে । তবে মোটামুটি এপেল , পিয়ার কিংবা দোহারা গড়নই বেশি। মেয়েদের বেলায় যেই আওয়ার গ্লাস ফিগারকে বিশ্ব ব্যাপী আদর্শ বানানো হয়েছে সেই মাপের দেহ পেতে পারবেন কেবল মাত্র ৫% মহিলা । বাকিদের কেউ কেউ সার্জারী করে পারবেন , তারপরেও বেশির ভাগই পাবেন না ।
তার মানে কি দাঁড়াইলো ?
প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ৫ জনের মত হওয়ার জন্য বাকি ৯৫ জন ক্রমাগত ক্রিম ঘষবেন, জিমে যাবেন, ডায়েট করবেন, বিশেষ ধরনের পোশাক পরবেন , কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে সার্জারী করাবেন। কিন্তু কেন?
কারণ , মিডিয়া আপনাকে শেখাবে , তোমার মডেল , তোমার আদর্শ হইলো আওয়ার গ্লাস । এইটা হইলো এমন এক খেলা যাতে মাঠে নামার আগেই আপনি হেরে বসে আছেন কিন্তু আপনাকে প্রতিনিয়তই ব্রেইন ওয়াশ করা হচ্ছে যে , আপনি জিতে যাবেন , আর একটা কিছু কিনলেই!
হু দা হেল আর দে টু টিচ আস হোয়াট ইজ , হু ইস বিউটিফুল? হু ইজ নট?
বাঙালী কয়টা ছেলের সিক্স প্যাক থাকে? সিক্স প্যাক না থাকলেই অন্য কারো গলায় ঝুলে পড়তে হবে? ব্লিঙ ব্লিঙ ডায়মন্ড রিং দিতে না পারলে রাস্তা মাপো ?
আওয়ার গ্লাস না হলে ভালোবাসা যাবে না?
এই প্রশ্ন গুলা আপনি তখন করবেন যখন আপনি একজন মুক্ত চিন্তার, যুক্তিবাদি , স্বাধীন মতের মানুষ হবেন । বিজ্ঞাপনের চটকে বিভ্রান্ত হবেন না । আমরা কয়জন তা পারি?
মানুষের সব চাইতে বড় সৌন্দর্য তার বৈচিত্র । বিচিত্র মানুষ তার বিচিত্র শরীর নিয়ে প্রেম , ভালোবাসা, সেক্স নিয়ে সুখে থাকুক। এইটাই হওয়া উচিত ।
কিন্তু মিডিয়া মোঘলরা , ফ্যাশন এন্ড কসমেটিকদের সাথে হাত মিলিয়ে আমাদের ব্রেইনে সুন্দরের একটা ফিক্সড ইমেজ গেঁথে দিতে বদ্ধ পরিকর । তাও আবার সেইটা শরীর এবং শরীর এর পূজারী।
-----------------------------------------------------
এই ধরনের বিজ্ঞাপন কি আসলেই মানুষকে অন্ধ করতে পারে ?
পারে । গবেষনায় দেখা গেছে একটা সৌন্দর্য পণ্য আদৌ কাজ করে কি করে না তা জানার দরকার নাই । ক্রেতা যদি বিশ্বাস করে যে পণ্যটা কাজ করলেও করতে পারে , তাহলেই চলবে । মানুষের কল্পনা ও সহজাত প্রবৃত্তি এর জন্য দায়ী। খুব ইমেডিয়েট , ক্ষুদ্র সাফল্যকে আমরা বড় করে দেখি । এবং ক্ষুদ্র সাফল্যের উপরে বেস করে বড় বড় রিস্ক নেই । এইটা একটা গেম অফ চান্স ।
লাস ভেগাসে ৯৮% ক্ষেত্রে জুয়াড়িদের জিততে দেওয়া হয় । মাত্র ২% লাভ করা হয় । আর এই মাত্র ২% লাভ দিয়েই মিলিওন মিলিওন ডলারের ব্যবসা চলে । কারন, মানুষ যতক্ষণ বিশ্বাস করবে , " আর একবার খেললেই সে জিতবে " - ততদিন লাস ভেগাসের ব্যবসা সেইফ । আর এক টিউব ফেয়ার এন্ড লাভলী মাখলেই আপনি ফর্সা হবেন ( পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও) , ইউনি লিভারের ব্যবসা সেইফ । স্রেফ হাওয়ার উপরে, মিথ্যার উপরে, ছলনার উপরে সাজানো এই ট্রিলিওন ট্রিলিওন ডলারের প্রসাধন ব্যবসা।
ক্রিম ঘষে আর সার্জারী করেই যদি এনজেলিনা জোলি হওয়া যেত, খোদ হলিউডেই প্রতিদিন ১০টা করে এনজেলিনা পয়দা হইত না?
----------------------------------
শেষের অংশটুকু আসলে লাল সালুর পোস্টে বলা হয়ে গেছে । সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে কামার্ত ব্লগাররা যেই হারে তাদের আদিরসাত্মক ফান করলেন আর দেশের ১০ হাজার " সম্ভাব্য পণ্য বিক্রেতাকে" বেশ্যা বানিয়ে ফেললেন , সেইটা আমার কাছে সেই ১৯৭১ এর ধর্ষকামী ভূতের আছর মনে হয়েছে। একটা মানুষের উপর চড়াও হওয়া তখনই সম্ভব যখন কোন ভাবে সবাইকে কনভিন্স করা সম্ভব যে তারা মানুষ নয় , আমাদের সমান নয়।
The first step towards the most horrific atrocities against human kind is to establish that they are "less than human" , less than what you are .
This happened with black slaves in Africa, this happened with the witch hunt in Europe, this happened with Jews in the holocaust, this happened exactly with 30 lakh people and 2 lakh women in the 1971 genocide in Bangladesh.
Not because they were black.
Not because they were witches.
Not because they were Jews.
Not because they were Bangali.
Because , they were less than human to their oppressors.
পূর্ব পাকিস্তানের মেয়েরা মানুষ নয় । ওরা হিন্দু। ওরা হিন্দুয়ানী ভাষায় কথা বলে। হিন্দুয়ানী পোশাক (শাড়ি) পরে । হিন্দু আচার সংস্কৃতি পালন করে । ওরা মুসল্মান নয় । সুতরাং উহারা মানবেতর ( মানুষের চেয়ে ইতর) প্রাণী ।
অতএব , পূর্ব পাকিস্থানী হিন্দু মেয়েদের খান সেনাদের খাট কাঁপানোর জন্য দিয়ে দেওয়া হউক।
-----------------------
লাক্স সুন্দরীরা বাঙ্গালী নয় । ওরা পশ্চিমা । ওরা বাংলা বলতে পারে না, ওরা খোলামেলা পোশাক পরে , ওরা পশ্চিমা আচার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত । ওরা মুসলমান নয় । সুতরাং উহারা মানবেতর ( মানুষের চেয়ে ইতর ) প্রানী ।
সুতরাং , ইহাদের দিয়ে খাট কাঁপানো হউক।
-----------------------------------
দুইটা গল্পে আমি কোন পার্থক্য পাই না ।
প্রথম গল্পে পাকিস্তানী জোশে জোশিলা রাজাকার ।
দ্বিতীয় গল্পে পাকিস্তানী জোশে জোশিলা বাঙ্গালী ।
সন্দেহ নাই , এই ধরনের প্রতিযোগিতাকে আমি সমর্থন করি না । কিন্তু প্রতিবাদ কিংবা ফানের নামে প্রতিযোগিনীদের সম্ভাব্য বেশ্যা বলে অপমান করাটা কিছুতেই সহ্য করা উচিত না । যেই ১০ হাজার মেয়ে অংশ নিয়েছে তারাও মানুষ । তাদের লাইফ চয়েস নিয়ে আমাদের আপত্তি থাকতে পারে , তার মানে এই না যে আমরা যাচ্ছেতাই ভাবে তাদের হেয় করবো, অবমাননা করবো।
-----------------------------------------------------
সুন্দরী প্রতিযোগিতা কিংবা কর্পোরেট পুঁজিবাদ কেবল নারী নয় , সবাইকেই পণ্য বানায় , ক্রেতা বানায় । হয় তুমি বিক্রি করবে নয় তুমি বিক্রি হবে । কারন এই মতবাদের মূলে আছে শুধুই লাভ , কেবল সাপ্লাই আর ডিমান্ড ।
কিন্তু মানুষের সবচেয়ে বড় যেই ডিমান্ড ,
ভালোবাসা । আধ্যাত্মিক বা স্পিরিচুয়াল নিড । মূল্য পাওয়া বা মূল্য দেওয়া । সম্মান ও সাফল্যের ভিতরে প্রচ্যের যেই দর্শন রয়েছে , সেই দর্শনকে পুঁজিবাদ ধ্বংস করতে চায় ।
আমরা যে বিশ্বাস করি , এই জীবনটাই সব নয় , এইখানে সব কিছু পাওয়ার নেশায় আশে পাশের সবাইকে, ন্যায় - নীতি - মূল্যবোধকে পায়ে দলে যাবার দরকার নেই ! সব কিছু খুবলে খাওয়া নয় , যা আছে - সেই সামান্যটুকুই সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়ার ভেতরে আনন্দ অনেক বেশি - এই সব পুঁজিবাদ বুঝে না ।
পুঁজিবাদ হলো সেই আগুন যা খেতে খেতে বড় হয় । যারা উচ্ছিষ্টটুকু পায়, তারা এর নানান গুণাগুণ বর্ননা করে । ইনোভেশন , ক্রিয়েটিভিটি, ডিস্কভারি , ব্লাহ ব্লাহ ।
কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে , কিসের মূল্যে ? এট দা কস্ট অফ হোয়াট?
------------------------------------------
আজকের যুগে আপনার বউ এর পেটে যেই ভ্রুণটা আছে সেইটাকে বের করে একজন ক্যান্সার রোগী , একজন হার্টের রোগী কিংবা একজন কিডনীর রোগীকে বাঁচানো সম্ভব।
এখন এই টেকনোলজিটাকে যদি কর্পোরেট পুঁজিবাদের সাথে তুলনা করি তাহলে , আপনি এই ধরনের পুঁজিবাদ ও অর্থনীতিকে সমর্থন করবেন কিনা তা নির্ভর করবে আপনি কি সেই
১। মা?
২। ভ্রুণ ?
৩। সার্জন ?
নাকি ,
৪। মৃত্যু পথযাত্রী রোগী?
লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার কারো কারো জন্য কিছু কিছু উপকার বয়ে আনবে এইটা সত্য। কিন্তু , প্রশ্ন সেই একটাই , কিসের বিনিময়ে? কতখানি মূল্যে?
http://www.somewhereinblog.net/blog/valobashablog/29085855
No comments:
Post a Comment