Monday, May 30, 2011

"হেলথ ফর অল (health for all)" এর জায়গায় "সমান উন্নয়ন সবার জন্য (Equal development for all)" কবে দেখবো? পর্ব - ২

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এই রকম হযবরল অবস্থা ও ভেঙে পড়ার কারণ কি?

আসুন এক এক করে কমন কিছু সমস্যাকে আলোচনা করে দেখি আসলেই সমস্যা যা মনে হয় তাই নাকি অন্য কোথাও। আমাদেরকে প্রথমেই মনে রাখতে হবে, দেশের ভিতরে যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমেই দরকার হবে সেই সমস্যার আদ্যপান্ত বিশ্লেষণ করে তার সমাধানে একটি রুপরেখা । রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাই যে কোন চাহিদাপূরণে বা সমস্যার সমাধানে দেশব্যপী বাস্তবায়নের একটি পলিসি পেপার থাকে। সেই পলিসি পেপারে সমস্যার উল্লেখ, চরিত্র ও সমাধানে করনীয় মূল দর্শন উল্লেখিত থাকে। এজন্য, প্রতিটা সমস্যার সমাধানে আমরা আগে দেখবো সেই সমস্যার ব্যাপারে আমাদের স্বাস্থ্যনীতি না পলিসি পেপারে কি বলা আছে, তারপর এর বাস্তবায়নে কি কি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, এবং তারপর বাস্তবতার নিরিখে এর সমাধান/ প্রস্তাবিত সমাধান।

আমাদের জনবল এর অভাবঃ
সন্দেহ নেই যে আমাদের জনবলের অভাব আছে । সেইটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই আছে । ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন এর এই ওয়েব সাইটে গেলে এ বিষয়ে নানা তথ্য পাবেন। বিশ্বব্যপী স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা মাপার জন্য জনপ্রতি ডাক্তারের সংখ্যা হিসাব করা হয়। পরিমাপ হিসেবে এর কার্যকারিতা খুব একটা ভালো নয়। কারণ একজন ডাক্তার ঠিক কয়জন নাগরিকের স্বাস্থ্যের দেখভাল করতে পারবেন তা নির্ভর করে সেই ডাক্তার, প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো , টেকনোলজির পাশাপাশি লোকালয়ের মানুষ কে কয়জন কি ধরণের অসুখে ভুগেন তার উপর। সুতরাং, আমেরিকা কিংবা ইউরোপে বসে আম একজন ডাক্তার হয়ত ৩০ হাজার মানুষের স্বাস্থ্যের দেখা শোনা করতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া কিংবা বেনিনে তা সম্ভব নয়। সুতরাং, জনবলের সংখ্যা তাত্ত্বিক হিসেব করে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ালেই সেবার মান বৃদ্ধি হবে না।

আমাদের যন্ত্রপাতির অভাবঃ

হেলথ টেকনোলজি বলতে আমরা অনেকেই যন্ত্রপাতি , সুঁচ সিরিঞ্জ বুঝি। আসলে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে হেলথ টেকনোলজি বলতে বুঝায় ঃ

১। সব ধরণের ফার্মাসিউটিক্যালস । এর ভিতর ওষুধের পাশাপাশি ভ্যাক্সিন, টিকা, হোমিওপ্যাথি সব রকম কেমিকেলই পড়বে।
২। স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহৃত সকল প্রকার যন্ত্রপাতি বা ডিভাইস । সেইটা সুতাও হইতে পারে, সিটি স্ক্যানারও হতে পারে, আবার মোবাইল টেলিফোন সহ যে কোন মোবাইল ডিভাইস যা রোগ প্রতিরোধ, রোগের নির্ণয় বা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে ।
৩। যে কোন ধরনের মাইনর ও মেজর সার্জিকাল প্রসিডিউর । মানে কাটাছেঁড়ার পদ্ধতি । ট্রিট্মেন্ট প্রটোকল ( যেমন - ক্যান্সার চিকিৎসার গাইড লাইন) এবং ক্লিনিকাল গাইড লাইন।
4. এমন কি স্বাস্থ্য সেবা কি ভাবে সাজানো গুছানো থাকবে এইটাও টেকনোলজির অন্তরভূক্ত ।
এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন ঃ
health technology include the following.
• Drugs: e.g., aspirin, beta-blockers, antibiotics, HMG-CoA reductase inhibitors (“statins”)
• Biologics: vaccines, blood products, cellular and gene therapies
• Devices, equipment and supplies: e.g., cardiac pacemakers, CT scanners, surgical gloves,diagnostic test kits
• Medical and surgical procedures: e.g., psychotherapy, nutrition counseling, coronary angiography, gall bladder removal
• Support systems: e.g., electronic patient record systems, tele-medicine systems, drug formularies,blood banks, clinical laboratories
• Organizational and managerial systems: e.g., prospective payment using diagnosis-related groups, alternative health care delivery configurations, clinical pathways, total quality management programs


এখন কথা হলো,
ক) এই টেকনোলজি গুলোর কয়টা আমাদের দেশে কোনখানে কয় পিস করে লাগবে, বেশি আছে না কম, কয়টা রোগীর জন্য কয়টা টেকনোলজি আসলেই দরকার -সেই সব ডাটা সংগ্রহ করা হয় কি?
-না হয় না। এই ধরনের ডাটা কালেকশন , এনালাইসিস এবং প্রাপ্ত রেজাল্টের উপর ভিত্তি করে যদি ডিসিশন নেওয়া হত তাহলে আমাদের অলরেডি অপ্রতুল রিসোর্স ( সেইটা জনবল, টেকনলজি বা অর্থ- সবই হতে পারে) কে এলোকেশন বা ভাগাভাগি করার সিদ্ধান্ত গুলো আরেকটু সঠিক হত। সম্পদের অপচয় হত না।

খ) বাংলাদেশ এখন যেই সব টেকনলজি ব্যবহার করে তাদের ভিতরে কোনটা কতটুকু নিরাপদ, কতটুকু ইফেক্টিভ ( যা করার কথা তা করে কি না) কতটুকু কস্ট ইফেক্টিভ ( সর্বনিম্ন দামে সর্বোচ্চ উপকার দেয় কিনা বা মূল্যের বিপরীতে পাওয়া উপকারের পরিমাণ) তা স্টাডি করা হয় কি না?
--- না হয় না । আমরা অন্ধের মত উন্নত বিশ্বের দেওয়া প্রেস্ক্রিপশন অনুকরণ করি। যদিও তাদের প্রেক্ষাপটে যা অমৃত , আমাদের প্রেক্ষাপটে তা বিষ হতে পারে। আবার, দামী দামী অনেক যন্ত্রপাতি কিনে এনে চালাতে পারি না, ফেলে রাখি। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা অনেক যন্ত্র অনুদান দেয়, যা অনেক সময় আউট ডেটেড বা সমস্যাযুক্ত।
প্রচুর প্রযুক্তি দাতা দেশের কোন কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করে । যেমন ভিটামিন যুক্ত ফর্টিফায়েড বিস্কিট কিংবা প্লাম্পি নাট । মানুষের খাবার উৎপাদন কিংবা ক্রয় ক্ষমতা অর্জনে উপার্জনের ব্যবস্থা না করে ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় করে এই নাট কেন খেতে হবে ? আবার, সবার জন্য নিরাপদ পানির সরবরাহে দেশীয় বিনিয়োগে পানি শোধনাগার স্থাপন না করে কেন কলেরা ভ্যাক্সিন উৎপাদন করতে হবে - এই গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালা কর্মকান্ড গুলার কারণ হইলো সঠিক এভিডেন্স বেজড ডিসিশন মেকিং প্রসেসের অভাব।

গ) টেকনোলজি গুলোর দাম কি আমাদের দেশের জন্য উপযুক্ত?
--- এক ওষুধ ছাড়া আর কিছুই আমাদের দেশের জন্য উপযুক্ত দাম নিয়ে আসে না। ওষুধ দেশীয় কোম্পানি গুলো তৈরী করে বলে তাও কিছুটা গা সোয়া। আগের ওষুধ নীতি অনুযায়ী উৎপাদন মূল্যের উপরে মাত্র ২০% লাভে ওষুধের দাম নির্ধারিত হত । পরে ওষুধ কোম্পানি গুলোর লবিং এর কারণে পলিসিতে পরিবর্তন করা হয়, এখন কোম্পানি গুলো ইচ্ছামত দাম নির্ধারণ করতে পারে। বিদেশে নতুন ওষুধ গবেষণায় বিলিওন বিলিওন টাকা ইনভেস্ট করে বলে কোম্পানি গুলোকে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে যাতে গবেষণায় উৎসাহ পায়। কিন্তু বাংলাদেশের কোন কোম্পানিরই রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট এ কোন বিনিয়োগ নেই। এরা সকলেই জেনেরিক ড্রাগ বা অন্যের আবিষ্কার করা ফর্মূলায় নিজেদের ওষুধ উৎপাদন করে। সুতরাং, এই ইচ্ছেমত দাম নির্ধারণের সুবিধা পাওয়াটা এক রকম সাংবিধানিক অধিকার লংঘন করে নাগরিকের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।

ঘ) টেকনোজির দাম সহনীয় রাখতে দেশে উৎপাদন সম্ভব?
--- অবশ্যই সম্ভব। এমন অনেক টেকনোলজি আছে যেইটা দেশেই উৎপাদন করা যায়, আমদানি করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগ। কিন্তু হায় হতিস্মি! দেশে একটা কম্পিউটার উৎপাদনের কোম্পানি নেই, কিন্তু বুয়েটসহ সকল টেকনিকাল ভার্সিটিতে সবাই হাক ডাক দিয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায়। অথচ একটা ভার্সিটিও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে না। আমাদের ছেলে মেয়েরা নাসার জন্য রোবট বানাইতে খুবই উৎসাহী কিন্তু দেশের ১৬ কোটি মানুষের ব্যবহারে লাগবে এমন হেলথ টেকনোলজির কোটি কোটি টাকার মার্কেট পড়ে আছে অবহেলিত।

ডাক্তারদের গালি দেওয়ার লোকের অভাব নাই। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বলা যায়, ডাক্তাররা যদি এক একটা কসাই হয়, তাহলে দেশের হেলথ টেকনলোজির অবহেলিত মার্কেটের জন্য ইঞ্জিনিয়াররাও এক একটা কসাই। চাঁদের দেশে মাটি কেমনে তোলা যাবে- এইটা নিয়ে চিন্তা করতে ভালো লাগে , কিন্তু নিজের দেশের মাটির প্রতি কোন দায় দায়িত্ববোধ এদের নাই। কেন বলছি? বুয়েট আর ঢাকা মেডিকেল পাশাপাশি। যতদিন ঢাকা মেডিকেলে ছিলাম, বহুবার বুয়েটের বন্ধুরা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে, বেড়াতে, সিঙ্গারা খেতে, প্রেম করতে এসেছেন- কিন্তু আজ পর্যন্ত দেখিনি বা শুনিনি কেউ এসে বলেছেন - মেডিকেলের এই সমস্যাটার সমাধান এই ডিজাইন দিয়ে করা যায়- কিংবা, ঐ সমস্যাটার একটা টেকনোলজিকাল সমাধান সম্ভব! এই অভিযোগ আমার নিজের বন্ধুদের বিরুদ্ধেও। কষ্ট লাগে যখন ভাবি, বুয়েটের বন্ধুরা প্রয়োজন হলে মেডিকেলে এসে বন্ধুর জন্য রক্ত দিয়ে গেছে - অথচ তাদের মাথায় একবারো আসে নাই যে তার শিক্ষা ও জ্ঞান প্রয়োগের ক্ষেত্রটাও তো হতে পারে ঢাকা মেডিকেল! আমি ডাক্তার হয়ে যখন নিজে হেলথ টেকনোলজি নিয়ে শিক্ষা লাভ করলাম, তখন জানলাম , আমার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুদেরও অনেক কিছু করার ছিলো , আছে- কিন্তু তারা এসব নিয়ে ভাবেই না! টিকেটিং সিস্টেম, পেশেন্ট রেকর্ড, পেশেন্ট ডাটাবেজ, মনিটরিং সিস্টেম, ড্রাগ ডিস্পেন্সারী ও কন্ট্রোল, ডিউটি রোস্টার, কমিউনিকেশন, লজিস্টিক্স , ম্যানেজমেন্ট --- কত কিছুই না ইঞ্জিনিয়ারদের উপর নির্ভরশীল, টেকনোলজিস্টদের উপরে নির্ভরশীল- কত্ত কিছু করার আছে!

আমাদের অর্থের অভাবঃ

এইটা একটা আরোপিত জুজুর ভয় জনিত সমস্যা । সন্দেহ নাই যে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের হার্টের একটা করে পেস মেকার, একবার করে এম আর আই / সিটি স্ক্যান কিংবা ৩০টা করে সিপ্রোফ্লক্সাসিন দেওয়া মত টাকা আমাদের নাই। কিন্তু এইটা মোটেই সত্যি কথা না যে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে অর্থ দিয়ে চিকিৎসা সেবা কেনার সামর্থ নাই। আগেও বলেছি , হাসপাতালে আসতে যাতায়াতে, আসার পরে বিভিন্ন টেস্ট আর ওষুধের পিছনে মানুষের শত শত টাকা খরচ হয়। কিন্তু টাকার কোন হিসাব নিকাশ নাই। এইটা কতিপয় কর্মকর্তা কিংবা দোকানীর পকেটে না ঢুকে সিস্টমেটিকালি সরকারী রেভেনিউ খাতে ঢুকলে হাসপাতাল গুলো অন্তত এখনকার চেয়ে বেশি ভালো ভালে পরিচালিত হতে পারত ।

দেখুন, আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব । এর জন্য যদি প্রতিনিয়ত দাতার কাছে ভিক্ষা চাইতে হয়, সে তো কুকুর লেলিয়ে দেবেই। তখন সেই কুকুরকে ডগ বিস্কিট খাওয়াতে আমাদের ঋণের অর্থ শেষ হয়ে যাবে। ঠিক এই কারণেই কষ্ট করে হলেও আমাদের উচিত স্বাস্থ্যখাত পরিচালনার পয়সাটা সঠিক জায়গায় দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এখন, সেই দেওয়াটা কি ভাবে হবে ট্যাক্স নাকি হেলথ ইন্সুরেন্স - এইটা আলোচনার দরকার আছে । অনেকেই মনে করেন, এখনকার পরিস্থিতিতে আমার যখন দরকার হচ্ছে আমি শুধু তখনই , নিজের জন্য টাকা খরচ করে চিকিৎসা নিচ্ছি । আর দরকার না হলে খরচ করছি না। এতে খুউউউউব লাভ হচ্ছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো , ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে আপনাকে যখন চিকিৎসা নিতে হচ্ছে- সেইটা জীবনে একবার হলেও - আপনি এক সাথে এত বেশি টাকা খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন যে ঐ একবারেই আপনাকে পথে বসে যেতে হতে পারে।

অল্টারনেটিভ কি?

কয়েক ধাপে বিভক্ত স্বাস্থ্য সেবা । এর খরচ যোগাড় করা হবে বিভিন্ন ট্যাক্স ও হেলথ ইন্সুরেন্সসহ অনুদানের মাধ্যমে। সেবা পাবেন সকল নাগরিক। সেবা পাওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক থাকবে কিন্তু সেবা নেওয়ার/ না নেওয়ার ফ্রিডম থাকবে। মূলত, সকল উপার্জনক্ষম নাগরিক একটা বেসিক হেলথ স্কীম দিয়ে সুরক্ষিত থাকবেন। কেউই বাদ পড়বেন না। বেসিকের নিচের মানুষ গতর খেটে এবং বেসিকের উপরের ধনী ব্যক্তিরা অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে হাইয়ার স্কীমের সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। আধুনিক কোন সেবার জন্য যেন বাংলাদেশের বাইরে যেতে না হয়, সেইটা সরকার নিশ্চিত করবে ডাক্তারদের ট্রেনিং ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও লোকবল দিয়ে।

বেসিক স্কীম ঃ

স্বাস্থ্য সেবা খাতের উন্ন্যনের জন্য কেবল মাত্র স্বাস্থ্য ট্যাক্স নেওয়া যায়- যা সকল নাগরিকের উপর বাধ্যতামূলক। এইটা বাধ্যতামূলক বেসিক হেলথ ইন্সুরেন্সও বলতে পারেন। বাংলাদেশের সকল উপার্জনক্ষম নাগরিক একটা ন্যুনতম অর্থ প্রতিমাসে দেবেন। এর বিপরীতে বেসিক চিকিৎসা সেবা স্কীম এর আন্ডারে কিছু নির্দিষ্ট সেবা এবং এসেন্সিয়াল মেডিসিন লিস্টের যে কোন ওষুধ নিতে পারবেন। কস্ট ইফেক্টিভনেস স্টাডি এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের উপরে পরিচালিত রিসার্চ দ্বারা প্রাপ্ত রিয়েল এভিডেন্স এর উপর নির্ভর করে একটা জাতীয় সাইন্টিফিক কাউন্সিল সরকারকে পরামর্শ দেবে - এই বেসিক স্কীমে কোন কোন সেবা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সরকারী সহ সকল বেসরকারী প্রতিষ্ঠান যারা বেসিক সেবা দিতে চায় , তাদেরকে লাইসেন্স ভূক্ত হতে হবে। এই বেসিক স্কীম পাওয়ার অধিকার সকলের।

বেসিকের নীচে পুওর স্কীমঃ

যাদের দেওয়ার সামর্থ নেই, তারা সরকারের স্পেশাল স্কীমের আন্ডারে থাকতে পারেন। যেমন - কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মত কাজের বিনিময়ে চিকিৎসা। সুস্থ অবস্থায় স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন কাজ করে দিয়ে আপনি বিভিন্ন ধরণের ভাউচার উপার্জন করতে পারবেন । অসুস্থ হলে ঐ ভাউচার দেখিয়ে চিকিৎসা নিতে পারবেন। যারা সিজনাল ওয়ার্কার - অর্থাৎ নিয়মিত আয় করতে পারেন না কিন্তু মাঝে মাঝে উপার্জন করেন - তারাও এই ভাউচার কিনতে পারবেন। এক একটি সেবার জন্য এক একটি ভাউচার থাকতে পারে। যেমন- মাতৃসেবা পাওয়ার জন্য ভাউচার। মেডিসিন ভাউচার ইত্যাদি। রোগী নিজেই নিজের প্রয়োজন মত তার জন্য দরকারী ভাউচার নিতে পারবে। এতে করে প্রচুর পার্ট টাইম কাজের সুযোগ হবে।

যথাযত পলিসির অভাবঃ

আমাদের মূল স্বাস্থ্যনীতি যথেষ্ট ভালো একটা পলিসি পেপার। প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য কমুইনিটি ক্লিনিক এবং ধাপে ধাপে কমিউনিটি থেকে ইউনিয়ন--> উপজেলা--> জেলা--> বিভাগ--> জাতীয় পর্যায়ে চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থাটা আসলেই খুব ভালো । সুচিন্তিত এবং সিস্টেমেটিক। তাইলে সমস্যাটা কোথায় ? সামগ্রিক ভাবে চিকিৎসা সেবা বা স্বাস্থ্য পরামর্শ দিতে হইলে কিছু পূর্ব শর্ত পালিত হইতে হবে। যেমন-

১। সেবাদানকারীর নিজের জ্ঞান
২। সেবাদানকারীকে সহায়তা দেওয়ার জন্য লোকবল
৩। সহায়তাকারী টেকনোলজি
৪। রোগ নির্ণইয়ের ব্যবস্থা
৫। রোগ নির্নয়ের পরে চিকিৎসা প্রদানের সরঞ্জাম, অবকাঠামো , ওষুধ পাতি ইত্যাদি ।

প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্যতৈরী করা কমিউনিটি ক্লিনিক/ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স/ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মানুষকে সেবা দেবে সেখানে কারা থাকবে? একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের জন্য সরকার স্বাস্থ্য পরিদর্শক, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও এবং স্বাস্থ্য সহকারীর ব্যবস্থা হেলথ কেয়ার নেটোয়ার্কে রেখেছেন। আবার ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন এম বি বি এস ডাক্তার এর পোস্ট তৈরী করা হয়েছে। উপজেলা, জেলা পর্যায়ে প্রচুর পোস্ট আছে কিন্তু এদের অনেক গুলোই খালি ।

চাকুরীর এই সোনার হরিণের বাজারেও কেন পোস্ট খালি পড়ে থাকে? এর বিবিধ কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে আমাদের রাজধানী কেন্দ্রিক উন্নয়ন। আমার জন্মের পর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত গত ৩ যুগে ঢাকা পরিবর্তিত হয়েছে দ্রুত । বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের এক মাত্র খোলা জানালা হলো ঢাকা । মানুষের জীবনের মৌল চাহিদার নিরিখে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, বাসস্থানের জন্য পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট , স্যানিটেশন , স্বাস্থ্য সেবার উন্নত প্রতিষ্ঠান, দেশের বড় বড় ফ্যাশন হাউজ, বিনোদন এর মাধ্যম - সবই ঢাকায় । যখন মেডিকেলে ভর্তি হই, রাজশাহী যেতে হয়েছিলো--- আমার মনে হচ্ছিলো পুরো রাজশাহী শহর ঢাকার যে কোন বড় পাড়া/মহল্লার ভিতরে অনায়াসে ঢুকে যাবে। সেখানে রাস্তার এক পাশে পাকা বাড়ি তো অন্য পাশে কাঁচা ঘর, উঠান, গরু চরে বেড়াচ্ছে । একই অভিজ্ঞতা ময়মনসিংহকে নিয়ে। ৪০ বছর পরে দিনাজপুরের সাদীপুরে বেড়াতে গিয়ে আমার মায়ের মন্তব্য " কিছুই বদলায়নি- যা ছিলো সবই আগের মত" । ভাবখানা এই রকম - ঢাকাই বাংলাদেশ । ঢাকা খাবে, ঘুমাবে, হাগু করবে - আর ঢাকার বাইরে পুরো দেশটা রয়েছেই শুধু ঢাকাকে খাদ্য, বস্ত্র, বিলাস ব্যাসনের উপকরণের যোগান দিতে।

সৌদি আরব যেমন তেলের টাকায় সারা বিশ্ব থেকে আগত সম্পদ ভোগ করে আর সেদেশে যাওয়া শ্রমিকদের "মিসকিন মিসকিন" বলে গালি দেয় - সত্যিকার অর্থে আমরা ঢাকাবাসীদের আচরণে খুব একটা পার্থক্য নেই। ঢাকার বাইরের মানুষেরা , বিশেষ করে চাষী-কামার- কুমোর- মুচি- শ্রমিকরা আমাদের কাছে মিসকিন। তাই ঐ সব মিসকিনদের জন্য ওয়াসার পানির লাইন, ডেসকোর বিদ্যুতের লাইন, কিউ বির ইন্টারনেট এর লাইন কিংবা উন্নত কল কারখানা, ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ কিংবা হাসপাতাল করতে আমাদের খুব গায়ে লাগে।

আমরা এতটাই স্বার্থপর শুয়োর প্রকৃতির মানুষ যে সারাদেশের সকল জেলায় ইউনিভার্সিটি স্থাপনের কথা শুনলে আমরা হায় হায় করে উঠি ! হায়, শিক্ষা ব্যবস্থার মানের তাহলে কি হবে? সত্যিই তো ! দেশের সবাই যদি ব্যাচেলর ডিগ্রী নিয়ে ফেলে, তাইলে আমি তো আর এক্সক্লুসিভ রইলাম না! অতএব, যে কোন মূল্যে মানুষের শিক্ষিত হওয়া ঠেকাও!

শুয়োর শব্দটা কি আপনাকে নাড়া দিলো ? তাহলে দেখুন-

আমাদের সমাজের উপর তলার মানুষেরা হয়ত দেখতে চান একদিন এমনকি ৩য় -৪র্থ শ্রেণীর চাকুরিজিবী রাও graduate , post graduate হবে । সেটা জাতির জন্য কতটা গৌরবের হবে তা চিন্তা করতেও আমি শিউরে উঠি । ---- এই হলো আমাদের অবস্থা । কোথায় শিক্ষার মান যাতে উন্নত ও সমান থাকে তার জন্য চেষ্টা করবো - তা না শিক্ষার মান এর স্বার্থে শিক্ষার পথই বন্ধ করে দাও! হক মাওলা!

তো এই ঢাকা কেন্দ্রিক উন্নয়নের ফলাফল হইলো ঢাকার বাইরে সম মানের শিক্ষা সহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা নাই। ফলে, কেউই ঢাকার বাইরে থাকতে চায় না। সকলেই বাইরে থেকে ঢাকায় চলে আসতে চায়। এই সমস্যার কথা যে সব ডাক্তার সরকারী চাকুরি ছেড়ে দিচ্ছেন তাদের কথাতেও উঠে এসেছে। যেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সকলেই ঢাকায় থাকতে চায়, সেখানে কেবল ডাক্তারদের মফস্বলে পড়ে থাকতে বলাটা অন্যায় এবং তারা সেখানে থাকবেন- এইটা আশা করাটা নিতান্তই আহাম্মকি।

কেন?

দেশের সেরা মেধাবীরা ডাক্তারী পড়ে। ডাক্তারী পড়াটা অনেক কষ্টের কাজ। ডাক্তাররা পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে চায়। ডাক্তারের পরিবারের (স্ত্রী/স্বামী) রাও মেধাবী কেউ হয় যারা ঢাকার মত বড় শহরে থেকে কাজ করে/করতে চায়। আর পরিবার চাকুরী না করলেও সন্তানদের দেশের সেরা স্কুল/কলেজে পড়াতে সকলেই চায়। তার উপরে বিদ্যুৎ, পানি, ইন্টারনেটের ব্যাপার তো আছেই। সুতরাং, শুধু ডাক্তার নয়, পাশাপাশি মেধাবী নার্স, প্যারামেডিক, টেকনিশিয়ানদের মফস্বলে, গ্রামে, ধরে রাখতে চাইলে তাদের থাকার জায়গাটাতে বিদ্যুৎ, পানি , ইন্টারনেটের সুবিধা দিতে হবে। তাদের সন্তানদের পড়ালেখার জন্য আশে পাশে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে। ঢাকার মার্কেট যে সব খাদ্য, বস্ত্র ও বিনোদন অফার করতে পারে - সেই মফস্বল বা গ্রামেও তা পৌছানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে।

এই দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করলে , বাংলাদেশের যে কোন রাজনৈতিক দল, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগকারী - কেউই সঠিক পলিসিতে চলে না। যেখানে দেশের হাজার হাজার বর্গ মাইল পড়ে আছে, কোটি কোটি কাঁচা ঘর - সেখানে কোন উন্নয়নের চিত্র নাই। পাকা বাড়ি বানানোর ব্যবস্থা করা - সে সব বাড়িতে ন্যুনতম বিদ্যুৎ, পানি, একটা করে টেলিফোন, ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করা - এই ধরনের কোন কার্যক্রম না লীগের ইশতেহারে আছে, না বি এন পির। এমন কি সাধারণ মানুষের দাবীতেও তেমন নেই। কারণ তারাও চায়, দরকার হইলে সরকার ফ্লাই ওভার, ওয়াক অভার, আকাশে বাতাসে ফ্ল্যাট গড়ে হলেও ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করে দিক।

তাহলে এর সমাধান কি?

সবার আগে দরকার কিছু পলিসি বা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া। যেমন-

যেই সরকারই ক্ষমতায় আসুক , সকল বিভাগ-->জেলা-->উপজেলা-->ইউনিয়ন--> গ্রাম পর্যায়ে সুযোগ, সুবিধা ও উন্নয়নের সমান মান, পরিমাণ ও চরিত্র বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকিবে।

সোজা বাংলায়, সুযোগ সুবিধার কিছু বেসিক লিস্ট থাকবে যেইটা সারা বাংলাদেশের জন্য সমান হবে।

ঢাকা বিভাগে যা যা থাকবে, বাকি সকল বিভাগে তা তা-ই থাকতে হবে।

ঢাকা বিভাগ সহ একই বিভাগের অধীনে সকল জেলায় সমান সুযোগ, সুবিধা ও সেবার ব্যবস্থা থাকবে।

একই ভাবে উপজেলা পর্যায়ে সকল উপজেলার জন্য একই ধরনের নাগরিক সেবা দিতে হবে। ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের বেলাতেও তাই।

কিছু মৌলিক অধিকারের কথা সকল নাগরিকের জন্য সমান ভাবেই সংবিধানে রচিত আছে । কিন্তু বাংলাদেশের যে কোন সরকার যখন কোন প্রকল্প নেয়, তখন সেই সব উন্নয়ন প্রকল্পের মূলনীতি হিসেবে কখনোই " সকলের জন্য সমান উন্নয়ন" - এই নীতি মেনে প্রকল্প ডিজাইন করে না। নইলে, যেদিন থেকে ঢাকায় ওয়াসা হয়েছে সেইদিন থেকেই বাংলাদেশের প্রতিটা জেলার পরিশোধিত পানির ব্যবস্থা চালুর প্রকল্প নেওয়া হত। প্রতিটা জেলায় , উপজেলায় একটা করে আগোরার মত সুপার মল থাকতো। কক্সবাজারকে বাই পাস করে ইন্টারনেট এর সুবিধা ঢাকায় ঢুকতে পারতো না । প্রতিটা নাগরিককে ইন্টারনেটের সুবিধার আওতায় আনার ইচ্ছা থাকলে ভারতে ইন্টারনেট রপ্তানির মত উদ্ভট প্রস্তাব শুনতে হত না।

আমেরিকায় বেশ কয়েক বছর থাকার পরে আমার এক আত্মীয় বলেছিলেন- সব শহর ঘোরার দরকার নেই। আমেরিকার কয়েকটা শহর দেখে ফেললে বাকি গুলো একই রকম লাগে। বাস থেকে নেমে চোখে পড়বে একটা ওয়াল মার্ট ।

হল্যান্ডবাসী এক বন্ধুর মন্তব্য ঃ
প্রায়ই পথ হারিয়ে ফেলি। কারণ রাস্তা - বাড়ি সব একই রকম দেখতে। এক শহরে বাস থেকে নামলে যে সব প্রতিষ্ঠান চোখে পড়ে, বাকি শহর গুলোতেও তাই। কেমন যেন সব কপি পেস্ট !

একি স্বপ্ন? না সম্ভব?

নিঃ সন্দেহে একদিনে সম্ভব না । আমেরিকা কিংবা হল্যান্ড এর মত দেশ কয়েক শত বছর ধরে একটু একটু করে আজকের অবস্থানে এসেছে। কারণ তাদের রাষ্ট্রনীতিতে স্পষ্ট লেখা আছে --- দেশের একটি এলাকা , তা রাজধানী থেকে যত দূরেই হউক আর কাছেই হউক --- অন্য সকল এলাকার মত সমান সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হইবে।

তাই, তারা যখন উন্নয়ন প্রকল্প নেয়, শুধু ঢাকা , শুধু চট্টগ্রাম কিংবা খুলনার জন্য নেয় না --- দেশের সকল জেলার জন্য নেয়। সকল উপজেলার জন্য নেয়।

মানুষের স্বভাব চরিত্র (মূলত ডাক্তার) খারাপ, সেবা দেওয়ার সঠিক মনভাব নাই।

এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । পুরো সিস্টেমটাই যখন নষ্ট হয়ে গেছে , যার যা ইচ্ছা তাই করছে , তখন এই ধরনের অধঃপতন হবেই। দরজা খোলা রেখে ঘুমালে চোরকে নামায পড়িয়ে লাভ নেই। সে চুরি করবেই। দরকার হলো দরজা বন্ধ করা, সামনে ক্যামেরা লাগানো, চোরের জন্য বিকল্প উপার্জনের পথ করা এবং তারপর মানুষকে উপদেশ দেওয়া যাতে তারা চোরাই মাল না কেনে।

একদিনে যেহেতু সারা বাংলাদেশকে ঢাকা বানায় ফেলা সম্ভব না - সেই জন্য এখনি অল্প অল্প করে কিছু কঠোর , কিছু সহযোগিতা মূলক পলিসি নেওয়া। যেমন- ঢাকায় আর নতুন আবাসন তৈরী করতে না দেওয়া । ঢাকার বাইরে অন্যান্য এলাকায় সরকারী - বেসরকারী - ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন, ইন্টারনেট সুবিধা সহ বাড়ি/ ফ্লাট বানানো। মানুষ যদি কিনে তো ভালো। না কিনতে পারলে কিস্তিতে ভাড়া দেওয়া । ঢাকার বাইরের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারী স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে এখনি উন্নত লাইব্রেরী, ইন্টারনেট , নিরাপদ পানি এবং প্রয়োজনে হোস্টেলের ব্যবস্থা করে দেওয়া।

ঢাকার বাইরে আবাসন, বিশ্ববিদ্যালয়, পরিশধিত পানির কারখানা ( ওয়াসার মত) এবং উন্নত মার্কেট স্থাপনের জন্য প্রাইভেট- পাবলিক বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা। যারা এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে তাদের বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সুবিধা দেওয়া ।

টেকনোলজির সর্বোচ্চ ব্যবহারঃ

বাংলাদেশের অনেক অনেক টাকা নেই। তাই অনেক কিছু হুট করে করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আজকের যুগে স্রেফ টেকনোলজির সাহায্য নিয়ে সারা বাংলাদেশের মানুষকে সমান সুযোগ ও সুবিধা দেওয়া সম্ভব। সেই রকম টেকনোলজি হচ্ছে আই সি টি এবং আই টি । আর কিছু না হোক, সারা বাংলাদেশে শুধু যদি হাই স্পিড ইন্টারনেট এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায় তাহলে বাকি আরো অনেক মৌল চাহিদা মেটানোর রাস্তা মানুষ নিজে ব্যক্তিগত উদ্যোগে, সমষ্টিগত ভাবে কমিউনিটি চেষ্টা বা প্রাইভেট বিনিয়োগে নিজেরাই করে নিতে পারবে।

টেকনোলজি তথা ইন্টেরনেট , কম্পিউটার, ভিডিও-অডিও ইত্যাদি নানা রকম টেকনোলজির কারণে এখন আর গ্রামে গ্রামে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল গড়ে তোলার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু আমাদের থিংকিং প্রসেস বদলানোর । আমেরিকার বাঙ্গালী সালমান খানের নাম আপনারা হয়ত শুনেছেন। সালমান আমাদের অতি পরিচিত ইন্টারনেট এবং ভিডিও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা দানের ব্যবস্থাটাকেই পালটে ফেলার চেষ্টা করছেন । না- তিনি স্কুল বন্ধ করতে বলেন নি। টিচারদের চাকুরী থেকে ছাটাই করে দিতে বলেননি । স্রেফ এইটুকু বলেছেন যে মিলে মিশে আনন্দ নিয়ে, এক একজনের সুবিধা ও সময় মত শিক্ষা দানের পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে। আগে যেমন শিক্ষা দানের গুরুরা বাসায় শিক্ষা দিতেন, একজন শিক্ষার্থী গুরুর সাথে আলোচনায় বসতেন, বছরের পর বছর দীক্ষা নিয়ে গুরু যখন বলতেন - হ্যাঁ , তোমার শিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে - তখন তারা বাকিদের দীক্ষা দিতে বেরুতেন। অনেকটা সেই রকম।

এই শিক্ষা ব্যবস্থার উপকারিতা কি?

প্রথম উপকারিতা ঃ সকলের জন্য সমান মানের শিক্ষক

আধুনিক যুগে মুশকিল হয়েছে আমরা সবাই মিলে গুরুর বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারছি না । আবার একই গুরুর পক্ষে হাজার হাজার মানুষকে শিক্ষা দিয়ে বেড়ানোও সম্ভব না । তাই দেশে দেশে স্কুলের প্রচলন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সব গ্রামে কি একই মানের শিক্ষক পাঠানো সম্ভব?
না।

কিন্তু একই মানের ভিডিও শিক্ষক পাঠানো সম্ভব?

হ্যাঁ। এই জন্যই সালমানের ১০ মিনিটের ভিডিও শিক্ষা এত জনপ্রিয় হয়েছে। সারা বিশ্ব থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন শিক্ষার্থী - বয়স কিংবা লেভেল নির্বিশেষে এই সব ভিডিও থেকে শিক্ষা নিচ্ছে । আমি নিজেও অংক করছি কয়েক দিন ধরে ।

দ্বিতীয় উপকারিতা ঃ সকলের জন্য সমান মানের সনদ

এর চেয়ে গণতান্ত্রিক, সামাজিক ন্যায় আর হয় না। পৃথিবীর কোন শিক্ষা যদি দাবী করতে পারে যে তারা সকল মানুষকে সমান সুযোগ, সমান সুবিধা , সমান দক্ষতার সনদ দিয়ে থাকে - তাহলে তা হলো এই সালমান খান একাডেমি । এখানে মানুষ ৮০-১০০% এর জন্য পড়ে না। এখানে সকলেরই লক্ষ্য থাকে ১০০% অর্জনের।

চিন্তা করে দেখুন - এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা যা বাধ্য করছে প্রতিটা শিক্ষার্থীকে ১০০% বা সুপার এ গ্রেড পেতে । তুমি যতক্ষণ না একটি বিষয়ের একটি লেসনে ১০০% দক্ষতা না পাচ্ছো , ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পরের লেসনে যাবেই না ! কি আশ্চর্য সাম্য! কি সুন্দর ন্যায়!

আমরা এখন কি করছি? কাউকে এ গ্রেড, কাউকে বি গ্রেড , কাউকে সি গ্রেডের সিল কপালে লাগিয়ে এস এস সি, এইচ এস সি সনদ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি। যারা ফার্স ক্লাস , তারা মাত্র ৬০% দক্ষতা নিয়ে পাশ করছে ।

একটু ভেবে দেখুন তো ! আপনি কোন গাড়িতে চড়বেন যার ব্রেক ৬০% কাজ করে? কিন্তু আপনি সেই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নেবেন যে কিনা মাত্র ৫০% দক্ষ । ( বাংলাদেশে মেডিকেলে পাশের জন্য ৫০% নম্বর পেতে হয়) তার মানে, বাকি ৫০% না জেনেও আমি আপনার গলায় ছুরি চালাতে আইনত অনুমোদিত !!!!!

অথচ সালমানের পদ্ধতিতে এনাটমিতে ১০০% দক্ষতা অর্জন না করে আমার পক্ষে সম্ভবই ছিলো না পরের সাবজেক্টে যাওয়ার।

এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে স্কুলে স্কুলে মান সম্মত ভিডিও পাঠানো যায়। দরকার শুধু ভিডিও প্লেয়ার একটি কম্পিউটার , আর বিদ্যুৎ। সোলার বিদ্যুৎ দিয়ে যে সব স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব হচ্ছে - সেখানে এই ধরণের ভিডিও চালানো যায়।

বাংলাদেশ সরকার টিভিতে ভালো স্কুলের ক্লাস প্রচার করবে। আমার কথা হলো, সেইটা রেকর্ড করে ইন্টারনেটে আপলোড করে দিলে দেশের যে কোন স্থান থেকে বার বার , যতবার ইচ্ছা , যতজনের ইচ্ছা নামিয়ে ব্যবহার করতে পারবে।

এর ফলে, (কি ভয়ানক কথা) আমাদের ৩য়-৪র্থ শ্রেনীর কর্মকর্তারাও অফিসের শেষে বাসায় বসে বসে পড়ালেখা করতে পারবেন। হাজার হাজার , লক্ষ লক্ষ মান সম্মত শিক্ষক তৈরীর প্রয়োজন কালকেই মিটানো সম্ভব না। কিন্তু এইটা খুবই সম্ভব যে মান সম্মত শিক্ষকদের দিয়ে ১০ মিনিটের ভিডিও বানিয়ে বানিয়ে সেইটা সারা বাংলাদেশে পৌছানোর ব্যবস্থা করা।

হাসপাতাল গুলোর ক্ষেত্রেঃ

কিছু জিনিসের অটোমাইজেশন প্রয়োজন । হাসপাতালে টিকেটিং, পেশেন্ট রেকর্ড ইত্যাদি প্রচুর ক্ষেত্রে ডাটা কালেকশন ও লজিস্টিক্সকে অটোমাইজ করে ভুল ত্রুটি , রোগীর চাপ ইত্যাদি কমানো সম্ভব। পাশাপাশি, আরেকটা জিনিস করা দরকার । তাহলো , ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানদের কাছে রেজিষ্ট্রি বাধ্যতামূলক করা । গ্রামের রোগীরা এবং শহরের ওয়ার্ডের রোগীরা প্রথমে তার নিজস্ব ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান এর কাছে যাবে। এরপর ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান রেফার করলে বিশেষজ্ঞদের কাছে যাবে। এতে করে সর্দি কাশির জন্য জাতীয় অধ্যাপকের কাছে যাওয়া বন্ধ হবে। এবং কেউ ২০ টাকায় বসে ওষুধের দোকানে রোগী দেখবে আর কেউ ধান্মন্ডিতে বসে কোটি টাকা কামাবে - এই অন্যায় ও বন্ধ হবে। যতজন এম বি বি এস , বি ডি এস রা পাশ করে বেরিয়েছেন - তাদের সকলের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে।

এই ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রিকৃত সকল মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ঐ এম বি বি এস এবং বি ডি এস দায়ী থাকবেন। সরকারের কাজ হবে মাঝে মাঝে র‍্যান্ডমলি কিছু লোকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা , তার কাগজ পত্র দেখা। প্রতি ৬ মাস অন্তর একজন বিডি এস কাছে চেক আপ করতে হবে। প্রতি এক বছর অন্তর এম বি বি এস এর কাছে । এর বাইরে অসুস্থ হলে তো দেখাবেই। সরকার যদি দেখে কোন ডাক্তারের আন্ডারে থাকা সকল মানুষের চেক আপের কাগজ পত্র, স্বাস্থ্য ইত্যাদি দেখ ভাল ঠিক মত আছে - তাহলে সেই অনুযায়ী বেতনের উপরে ডাক্তারদের ইঙ্ক্রিমেন্ট বাড়বে।

যেই ডাক্তার যত বেশি রিমোট অঞ্চলে কাজ করবেন , তিনি তত বেশি বেতন পাবেন। ( এইটা চালু থাকবে, যতদিন না রিমোট অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নত হচ্ছে) ।

৬০০০ মানুষের কাগজ পত্র ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যদি অবহেলা পাওয়া যায় , তাহলে ডাক্তারকে শো কজ করা যাইতে পারে। এতে করে , ডাক্তারদের "গড" এর আচরণ করা কমবে। ভুয়া ডাক্তারীও বন্ধ হবে- যেহেতু মানুষের স্বাস্থ্যের উপরে নির্ভর করছে সেবাদানকারীর বেতন-ভাতা।

অনেক আপত্তি থাকতে পারে এই সব সমাধানে । আপনারা আলোচনা করুন। সমাধান বেরিয়ে আসুক।

"হেলথ ফর অল (health for all)" এর জায়গায় "সমান উন্নয়ন সবার জন্য (Equal development for all)" কবে দেখবো? পর্ব - ১

বাংলাদেশের হেলথ সার্ভিস অর্থাৎ সরকারী, বেসরকারী (স্বাস্থ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান) বা এন জি ও প্রদত্ত স্বাস্থ্য সেবা নিতে গিয়ে -
১। আপনি কি কোন বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়েছেন?
২। আপনি কি কোন আর্থিক, মানসিক, শারীরীক বা সামাজিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন?
৩। অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার কারণে কোন আপন জন হারিয়েছেন?
৪। অবহেলা- ভুল চিকিৎসার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা কাউকে হতে দেখেছেন?


আমার কাছে কোন ভরসাযোগ্য দেশব্যাপী পরিচালিত জনমিতি (population statistics) নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, উপরের যে কোন একটি প্রশ্নের উত্তর আপনি যেই হোন না কেন, বাংলাদেশবাসী হলে, "হ্যাঁ" হবেই। আমি ১০০% নিশ্চিত। আসুন, মূল আলোচনায় যাবার আগে দেখি, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কি ধরণের সেবা পাওয়ার অধিকার আপনার আমার আছে।

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অধিকার

চিকিৎসা একটি সেবা, অর্থাৎ Public Good। কোন ব্যবসা পণ্য নয়। এর মানে হলো, আপনি বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী স্থান, কাল, পাত্র, জাতি, ধর্ম, উপার্জন- এমন কি নাগরিকত্ব নির্বিশেষে বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত যে কোন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অধিকারী। (per Section 15(A) of the Bangladesh Constitution, and develop the health and nutrition status of the people as per Section 18(A) of the Bangladesh Constitution.)

বাংলাদেশের হেলথ পলিসি আমাদেরকে বলে-
Health is defined asঃ

“A state of complete physical, mental and social well-being and not merely the absence of disease or infirmity.” -- অর্থাৎ শুধু নিরোগ হইলেই চলবে না, রাষ্ট্র আপনাকে আমাকে শারীরীক, মানসিক ও সামাজিক "ভালো থাকা"কে নিশ্চিত করতে অঙ্গীকার করছে। সেই ভালো থাকার রুপটি কেমন?

১। Every Citizen has the basic right to adequate health care - চিকিত্তসা সেবা পাওয়ার অধিকার
২। The State and the government are constitutionally obliged to ensure health care for its citizens - নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সরকারের
৩। To ensure an effective health care system that responds to the need of a healthy nation, a health policy provides the vision and mission for development. - একটি লিখিত নীতি দ্বারা উল্লেখিত
৪। Pursuance of such policy will fulfill the demands of the people of the country, while the health service providers will be encouraged and inspired. People’s physical well-being and free thought process have proved to be a precondition for the growth and intellectual enrichment in today’s human society -- সেই লিখিত সনদ এর বাস্তবায়ন নাগরিকের চাওয়াকে মেটাবে, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহী করবে।
এর পাশাপাশি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মানুষের সুস্বাস্থ্য ও স্বাধীন চিন্তা চেতনা আধুনিক মানব সমাজের উন্নয়ন ও মানসিক বিকাশের আবশ্যিক পূর্ব শর্ত।

সাক্ষরিত চুক্তি সমূহঃ Bangladesh expressed agreement on the declarations:
১। Alma Ata, 1978
২। The World Summit for Children 1990
৩। International Conference on Population and Development, 1994
৪। Beijing Women’s Conference, 1995

Ministry of Health & Family Welfare seeks to create conditions whereby the people of Bangladesh have the opportunity to reach and maintain the highest attainable level of people health. It is a vision that recognizes health as a fundamental human right and therefore the need to promote health and reduce suffering in the spirit of social justice. --- এইটা আমাদের বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের "vision" আর এইটা হইলো "objective" ।

ভিশন অনুযায়ী , তিনটা বিষয় গুরুত্ব পূর্ণ। অর্জনযোগ্য সর্বোচ্চ স্তরের স্বাস্থ্য, মৌলিক মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যয় অর্জনের সাথে দেশের স্বাস্থ্য অধিকার-সেবা - সিস্টেমকে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে ।

মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইটে আরো দেওয়া আছে এই সব ভিশন, মিশন, অব্জেক্টিভ, গোল ইতাদি অর্জন করার রুপ রেখা। তার ভিতরে একটি গুরুত্ব পূর্ণ সনদ হইলো আলমা আটা ১৯৭৮ । এইটা রুচি কিংবা তীর আটা নয়, একটা চুক্তি যাতে বাংলাদেশ সরকার সাইন করে এই প্রতিজ্ঞা করেছে যে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য সেবা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। এই কারণেই প্রতিটা স্বাস্থ্য, মা, বাবা, নাতি-পুতি, বন্ধু দিবসে, নিরাপদ পানি, ভাত, পায়খানা দিবসে, এবং বিভিন্ন আমাশা, ডায়রিয়া, এইডস, ম্যালেরিয়া দিবসে ঘুরে ফিরে এই "সকলের জন্য স্বাস্থ্য" বাক্যটি বারংবার উচ্চারিত হয়।

এইবার আসুন দেখি, বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে এই সব ঘোষণা ও দিবসের কি হাল?
এইখানে ১৯৯৭-২০০৭ সন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যখাতের খরচের হিসাব আছে ।

এইখানে আছে হাসপাতাল গুলোর রিপোর্ট কার্ড ২০০৭

কারা সেবা প্রাপ্ত হয়, সেই বেনিফিশিয়ারী রিপোর্টের পিডি এফ টাই নামানো গেলো না। মুমূর্ষু পি ডি এফ নিজেই।

এত গেলো সরকারী হিসেব কিতাবে। এখন কাজীর গরু মাঠে নামলে কি দেখা যায়?

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, মেডিকেল স্টুডেন্টদের এক নম্বর পছন্দের কলেজ ঢাকা, দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসা ব্যবস্থা (টারশিয়ারী) একাডেমিক মেডিকেল হসপিটাল ঢাকার রাতের অবস্থা

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে ব্লগার রেজোয়ানসহ অনেকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

বিশেষজ্ঞসহ ডাক্তাররা স্বাস্থ্যসেবার সরকারী খাত ছেড়ে পালাচ্ছেন ।

রাজধানী ছেড়ে একটু বাইরে গেলেই স্বাস্থ্যসেবা কেতাবী গরু হয়ে যায়। দূর ভোলার চিত্র কি হতে পারে? সমকালের রিপোর্ট ঝাড়ূদার যখন ডাক্তার!

ভুক্তভোগী রোগী ও দর্শক হিসেবে আমাদের কু অভিজ্ঞতার শেষ নাই। ডাক্তাররা নিজেরা কি বলছেন?

বেসরকারি ব্যয়বহুল হাসপাতালে সুযোগ-সুবিধা বেশি, এটি সত্য। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে কোনো সরকারই চিকিৎসকদের মেধার গুরুত্ব দেয়নি। বদলি, পদোন্নতি ও পদায়নে রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য হয়ে গেছে। তাই হতাশ ও বাধ্য হয়ে তাঁরা চাকরি ছেড়েছেন।

ঢাকার বাইরে বেশির ভাগ জায়গায় এখনো সপরিবারে থাকার মতো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। মূলত সে কারণেই তিনি চাকরি ছেড়েছেন।

তাঁর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ যে বিষয়ের ওপর, তা প্রয়োগের জন্য ঢাকাই একমাত্র জায়গা

কিন্তু তাঁকে বদলি করা হয় টাঙ্গাইলের একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে রোগীদের প্যারাসিটামল ও হিস্টাসিন দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না।

চিকিৎসকদের বদলির ভয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রভাব পড়ছে দরিদ্র সাধারণ মানুষের ওপর।

এক সময় বিএনপি-সমর্থিত ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) একজন ব্যক্তি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখন স্বাচিপের অসংখ্য দরবেশ, মোয়াজ্জিন গজিয়েছে। তাদের তোষামোদ করে চলা কোনো সুস্থ, শিক্ষিত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনিও চাকরি ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান।


এর পাশাপাশি বেতন বৈষম্য নিয়ে একজন পাঠকের মন্তব্য ঃ

একজন অধ্যাপক চিকিৎসকের সর্বচ্চ বেতন ৪০,০০০ টাকা। একজন সদ্য প্রকৌশলী তো এই বেতনে চাকরী করতে চাইবেন না।

সূত্রঃ প্রথম আলো

এবার আলোচনাঃ

উপরের উদাহরণ গুলো থেকে দেখা যাচ্ছে , স্বাস্থ্য সেবা খাতের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠান, সেবা প্রদানকারী এবং রোগীরা কেউই ভালো নেই। সংবিধান এবং স্বাস্থ্যনীতি আমাদের যে "ভালো থাকার" অঙ্গীকার করে, বাস্তবে তার দেখা পাওয়া মুশকিল। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ, প্রধান্মন্ত্রীর কানের চিকিৎসা করার সামর্থ বাংলাদেশে নাই। মন্ত্রী , সাংসদসহ সকল ধনী ব্যক্তিরা পারলে বিদেশে চিকিসা নেয়। গরীব লোকেরা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, আমেরিকা না পারুন, অন্তত পাশের দেশ ভারতের কোলকাতা, মাদ্রাজ -এ গিয়ে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এই রকম হযবরল অবস্থা ও ভেঙে পড়ার কারণ কি?

অনেকেই বলেন আমাদের জনবল, যন্ত্রপাতি ও অর্থের অভাব। যথাযত পলিসির অভাব। মানুষের স্বভাব চরিত্র (মূলত ডাক্তার) খারাপ, সেবা দেওয়ার সঠিক মনভাব নাই। প্রচুর প্রস্তাবে মানুষ ভেটো দিয়ে বসে থাকে। যেমন - হাসপাতালের টিকেটের দাম বাড়ানো যাবে না অথচ এমনিতেও আগত রোগীদের পকেট থেকে শত শত টাকা খরচ হয়ে যায়। স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের জন্য অর্থ খরচের বেলায় দাতা দেশের কাছে হাত পেতে বসে থাকতে হয় অথচ সকল প্রকার চিকিৎসা "ফ্রি" । সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বলতে কতগুলো ইটকাঠের বিল্ডিং করে রাখা হয়েছে কিন্তু সেই অবকাঠামো চালাতে হলে পারিপার্শ্বিক যেই সুযোগ সুবিধা (পলিসি, জনবল, বিদ্যুৎ, পানি থেকে শুরু করে জীবন যাপনের মৌলিক চাহিদা পূরণের উন্নত ব্যবস্থা) দরকার , সেসবের সমন্বয় করতে বলতে " ইহা আমাদের দায়িত্ব নহে" ধরনের মনভাব।


পোস্ট বেশ বড় হয়ে গেলো। পরের পর্বে এই সব কারণ , সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে লিখবো।

দেশের সব খেটে খাওয়া মানুষেরাই কি দালাল?

আজকে প্রথম আলো পত্রিকার একটা খবরে চোখ আটকে গেলো । বাংলাদেশের শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে প্রায়ই খবর আসে। দেশের ভিতরে যার মাধ্যমে টাকা দিয়ে ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে পৌঁছায়, রিক্রুটিং এজেন্সি, বাংলাদেশের দূতাবাস এবং সংশ্লিষ্ট দেশের কোম্পানিসহ প্রশাসন - কারো কাছেই এই গরীব মানুষ গুলো কোন সাহায্য পায় না। বরং পদে পদে হয়রানির শেষ নাই। বছর শেষে গাল ভরা " রেমিটেন্স" স্ট্যাটিস্টিক্স ছাড়া এই রক্ত মাংসের মানুষ গুলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের "আধুনিক দাস" , শোষিত , অবহেলিত।

উল্লেখিত খবরেও এর ব্যাতিক্রমী কোন নতুন তথ্য নেই। তবে তথ্য আছে কিছু "দালালের সম্পর্কে" । এরা হোল মধ্যস্বত্তভোগী । সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে -ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সির হয়ে এরা - বিদেশে যেতে ইচ্ছুক - শ্রমিক সংগ্রহ করে।

উল্লেখিত খবরে পাওয়া কিছু তথ্যঃ

১। ঢাকার বাইরে কারও অফিস নেই: বায়রার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন এক হাজার রিক্রুটিং এজেন্সি আছে। কিন্তু এদের সবার অফিসই ঢাকায়। সরকারিভাবে ঢাকার বাইরে তাদের অফিস নেওয়ার জন্য বলা হলেও কেউ-ই ঢাকার বাইরে অফিস নেয়নি।

এর কারণ সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা যায়নি। একজন মন্তব্যকারী আকরাম তানিম বলেছেন,
সরকারিভাবে ঢাকার বাইরে তাদের অফিস নেওয়ার জন্য বলা হলেও কেউ-ই ঢাকার বাইরে অফিস নেয়নি। " কিভাবে নেবে ? আমার জানা অভিগ্ণতা থেকে বলছি, এলাকার মাস্তানরা চাঁদা চাইবে, অফিস ভাংচুর করবে, প্রশাসনও ঝামেলা করবে। কি দরকার ?

তারমানে, ঢাকার বাইরে ব্যবসা করার মত যথেষ্ট নিরাপত্তা সরকার দিতে পারছে না। আবার কারণটা এইটাও হতে পারে- ঢাকায় বসেই যদি ব্যবসা করা যায়, ঢাকার বাইরে তারা যাবে কেন? অর্থাৎ এইখানেও সরকারের নিয়ন্ত্রনের অভাব। মনিটরিং এর অভাব।

২। দালালদের সহায়তায় বিদেশে যেতে পারলেও সরকার-নির্ধারিত খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়। মালয়েশিয়া যেতে সরকারি খরচ ৮৪ হাজার টাকা, অথচ দিতে হয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা।

এইখানেও সরকারের মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রনের অভাব।

৩। অথচ গ্রামগঞ্জ ও শহরে ছড়িয়ে আছে ৫০ হাজার থেকে লাখ খানেক দালাল। ----লক্ষ্য করুণ, এই এজেন্টদের সঠিক সংখ্যা কারো জানা নেই। এইখানেও সরকারের তথ্য সংগ্রহ , সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রনের অভাব।


৪। ‘বিদেশগামী এবং রিক্রুটিং এজেন্সি দুই পক্ষই এখন দালালদের ওপর নির্ভরশীল। একজন কর্মী বিদেশে যেতে চাইলে কোথায় যাবেন, কী করবেন—সে ব্যাপারে যথেষ্ট সরকারি তথ্য নেই। এই সুযোগ নেয় দালালেরা। আবার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর তৃণমূলে কোনো কার্যক্রম নেই। তাদের সবার অফিস ঢাকায়। ফলে তাদেরও বিদেশে পাঠানোর জন্য লোক আনতে এই দালালদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এভাবেই দালালপ্রথা টিকে আছে বছরের পর বছর। --- এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই কি দুর্নীতির কারণ নাকি এই চক্র এর উপর কোন নিয়ন্ত্রন না থাকাটা আসল সমস্যা?

৫। প্রমাণ ছাড়াই অর্থ লেনদেনের ফলে প্রতারণা, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, বিদেশ যাওয়ার খরচ বেড়েই চলেছে।

৬। বিদেশে আদম রপ্তানির সাথে জড়িতরা সকলেই রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রীর আত্মীয়। অনেক নেতা নিজেরাই ব্যবসার সাথে জড়িত। ফলে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা হয় - এমন কোন আইন হয় না। হলেও তার প্রয়োগ হয় না।

গরীব মানুষ গুলোই কি সমস্যা?

কথায় কথায় আমরা দালাল আখ্যা দিয়ে যে কোন প্রক্রিয়াকে দালালমুক্ত করার কথা হুট করে বলে ফেলি। অথচ সারা খবরে এমন কোন তথ্য নেই যে এই দালালেরা কোটিপতি। বরং আদম ব্যবসায়ী , লাইসেন্সপ্রাপ্ত, নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সী গুলোর অনেক মালিকই বরং চরম ধনী।

একবারও কি ভেবে দেখছি যে এই লোক গুলোর অন্য কর্ম সংস্থান নেই? এই দালালির ইনকাম বন্ধ করে দেওয়ার পরে এরা কি করবে? চুরি? ডাকাতি? হত্যা? আমাদেরকে আরেকটু গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করে তারপর পরামর্শ দেওয়া উচিত। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, প্রতারণা যেমন বন্ধ করতে হবে, সেই রকম ভাবে - শ্রমিকের স্বার্থ, রিক্রুটিং এজেন্সির স্বার্থ, এই এক লাখ মানুষের উপার্জনের স্বার্থও দেখতে হবে। দেশে কোন কর্ম সংস্থান নেই। হুট করে দালাল বলে গালি দিচ্ছি, আমরা এই মানুষ গুলা বা তাদের পরিবারকে খাওয়ানো পরানোর দায় দায়িত্ব নেব? কিন্তু সরকারের তো এই দায়িত্ব ভুলে গেলে চলে না, তাই না?

কারো উপার্জনের পথ বন্ধ করে না দিয়ে বরং প্রতারণা আর নিয়ন্ত্রনহীনতাকে বরং দূর করা উচিত। সরকারের কাজ মানুষের রোজগারের পথ বন্ধ করে দেওয়া নয়, রোজগারের পথ নিয়ন্ত্রন করা - যাতে একজনের রোজগার অন্য কারো ক্ষতি না করে।

কারো রুটি রুজির পথ বন্ধ না করে বরং নিম্ন লিখিত ব্যবস্থা গুলো নিন। সরকার বা রিক্রুটিং এজেন্সি - কেউই যখন গ্রামে গঞ্জে এমপ্লয়মেন্ট অফিস খুলছেন না (আপাতত) পুরো প্রক্রিয়াটাকে নিয়ন্ত্রন করুন। যারা অলরেডি এই ফিল্ডে কাজ করছে, তাদেরকে সঠিক ভাবে আইন ও লাইসেন্সের আওতায় আনুন।

১। যারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে লোক সংগ্রহ করে, তাদেরকে লাইসেন্স দিন, তাদের নাম-ধাম-ঠিকানা- সম্পূর্ণ পরিচয় লিপিবদ্ধ করে কাগজে , পেপারে, অনলাইন ওয়েব সাইটে ( সরকারী ওয়েবসাইট ও অনলাইন পত্রিকা) পাবলিশ করে দিন।

ক) কারা এই ধরনের কাজ করতে পারবেন তার একটা বর্ননা ও লাইসেন্স পাওয়া পদ্ধতি ঠিক করে দিন।
খ) শ্রমিকদের সন্তুষ্টির উপরে নম্বর/রেটিং দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। যার ইউজার রেটিং যত ভালো হবে, তার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করুন। এই রেটিং নির্ভর করবে, ঐ জবে যাওয়ার পরে শ্রমিক ভাই বোনেরা কতটা ভালো আছেন তার উপরে ( কাজ, বেতন, সুবিধা শর্তমত পেয়েছে কিনা)
পুরস্কার দেওয়া উচিত কারণ এই মানুষ গুলো কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করছে। সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারলে এতে দেশের আয় হয়।

২। দালাল ও শ্রমিক, উভয় পক্ষের জন্য ব্যাংক একাউন্ট খুলে দিন । সমস্ত টাকা পয়সার লেন দেন ব্যাংকের মাধ্যমে করার ব্যবস্থা করুন। ব্যাংক ব্যবহারের জন্য ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করুন। বিদেশ থেকে কি ভাবে টাকা পাঠাবেন, কি ভাবে দেশে যোগাযোগ করবেন ইত্যাদির ট্রেনিং দিন। এই ট্রেনিং এর ব্যবস্থা রিক্রুটিং এজেন্সিই করতে পারে। সরকার শুধু আইন তৈরী ও মনিটরিং করবে।

৩। প্রতিটা এজেন্ট কাকে কাকে, কোন রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে নিয়ে যাচ্ছে - তার রেকর্ড রাখার ( কাগজ ও অনলাইনে) ব্যবস্থা করুন।

৪। প্রতিটা শ্রমিক যখন বিদেশে যায় - তখন সেই শ্রমিকের পরিচয়ের পূর্ণ বিবরণ, যেমন --
ক) নাম
খ) ঠিকানা
গ) ছবি
ঘ) ব্যাংক একাউন্ট এর তথ্য
ঞ) তার পরিবারের তথ্য-পরিচয়, যোগাযোগের ঠিকানা, টেলিফোন, ছবি
চ) যার মাধ্যমে রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে গেছে তার তথ্য- পরিচয়, যোগাযোগের ঠিকানা, টেলিফোন, ছবি, লাইসেন্স নম্বর
ছ) রিক্রুটিং এজেন্সির তথ্য-নাম, অফিসের ঠিকানা, টেলিফোন, লাইসেন্স নম্বর
জ) যেই কোম্পানিতে কাজ করতে যাচ্ছে সেই কোম্পানির পরিচয়- নাম, অফিসের ঠিকানা, টেলিফোন, লাইসেন্স নম্বর
ঝ) যে কাজ করতে যাচ্ছে তার বর্ননা-পদ, দায়িত্বের বিবরণ, বেতন, শর্তসমূহ

--- উপরের সমস্ত তথ্যে এক কপি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়সমূহ, এক কপি রিক্রুটিং এজেন্সি ও এক কপি সেই দেশের দূতাবাসে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

এই তথ্যগুলো যাচাই ও সম্পন্নের জন্য এয়ারপোর্টে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অফিস, কম্পিউটারের শিক্ষায় শিক্ষিত কর্মী রাখার ব্যবস্থা করুন। -- দেশের অন্য কোথাও যদি কেউ মিস হয়েও যায় - অন্তত এয়ারপোর্টে , প্লেনে উঠার আগে তাকে ধরার এবং সাহায্য করার ব্যবস্থা করুন।

৫। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হলে ভিসা দেওয়া হবে না।

৬। শ্রমিকদের ডিজিটাল পরিচয় পত্র দিন যেখানে ৪ নম্বরের সমস্ত তথ্য ঐ ডিজিটাল কার্ডের চিপে সংরক্ষিত থাকবে। যে কোন প্রশাসন কার্ড রিডারের মাধ্যমে এই তথ্য যে কোন সময় এক্সেস করতে পারবেন। এয়ারপোর্টে এই কার্ড দেখিয়ে , তথ্য যাচাই করে প্লেনে উঠার অনুমতি দেওয়া হবে, নইলে নয়।

আজকের টেকনলজির যুগে নিয়ম করে এই সামান্য কাজ টুকু করা কোন ব্যাপারই না।

Friday, March 25, 2011

লাক্স এর চামড়া ব্যবসা , দর্শকের দেহ কামনা আর ব্লগে ধর্ষকামী ভূতের আছর - ১ম পর্ব

শিরোণাম পড়েই হয়ত বুঝে নিয়েছেন সাম্প্রতিক আলোচিত , নন্দিত (সামান্যই) এবং নিন্দিত লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার অনুষ্ঠান্টি নিয়ে আরো একটি লেবু কচলানো হতে যাচ্ছে । নাহ, এখনই বিরক্ত হয়ে ফিরে যাবেন না । মেয়েদের শরীর প্রদর্শন , বাঙ্গালীত্ব , ধর্ম তত্ত্ব - এই সব কচলানো লেবু নিয়ে তিতা করার কোন ইচ্ছা আমার নাই । আমি বরং আমার ফিল্ডের কাছাকাছি মেডিকেল ও বৈজ্ঞানিক কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই । আর যেই বিষয়টায় আমার চিরকালীন এলার্জি আছে , সেই মেগা কর্পোরেট দুনিয়া কি ভাবে আমাদের মন, মেধা , মনন ও স্বাভাবিক বুদ্ধি বিবেচনা খেয়ে ফেলছে , তাই নিয়ে দু'চারটা কথা বলতে চাই ।

নিঃসন্দেহে সৌন্দর্য চর্চা একটা ব্যবসা । ট্রিলিওন ট্রিলিওন ডলারের ব্যবসা । এই ব্যবসার মূলে আছে মূলত কর্পোরেট পুঁজিবাদ । পুঁজিবাদ কি বলে? পুঁজিবাদ বলে প্রোডাকশন বা উৎপাদনের সব রকমের উপাদান , মালামাল বা সার্ভিস, বিক্রি ও লাভ - সব কিছুর মালিক হবে ব্যক্তি । উৎপাদন প্রক্রিয়ার লেন দেন হবে মার্কেটে এবং বেতন ও দাম নির্ধারন করবে মার্কেট । কর্পোরেট পুঁজিবাদ বলা হয় সাধারণত ঐ ধরনের ব্যবস্থাকে যেইখানে , আইন অনুযায়ী কর্পোরেশন বা সংস্থাকে হতে হবে প্রফিট ওরিয়েন্টেড । অর্থাৎ , একটা হাঁচি কাশি দিতে গেলেও সেইখানে আপনার লাভ থাকতে হবে । অর্থনীতির ড্রাইভার সমূহ একটি এবং একটি মাত্র লক্ষ্য নিয়ে আগাবে তা হলো " প্রফিট বা লাভ" ।

কমিউনিজম বা সোসালিজম এর সাথে এর মূল পার্থক্যটা হলো , কমুইনিটি বা সোসাইটির সার্বিক লাভালাভ এইখানে বিবেচ্য থাকে না । বিবেচ্য থাকে কর্পোরেট এর লাভ। মালিক যেহেতু ব্যক্তি তাই ব্যক্তিগত লাভ। তাতে সমস্যাটা কি ?

সমস্যাটা হলো , আপনাকে যখন পুরো কমিউনিটি বা সোসাইটির লাভ মাথায় রেখে লেন দেন করতে হবে , তখন আপনি এই কমিউনিটি বা সোসাইটির কোন সদস্যের কোন ক্ষতি হয় , এমন কোন লেন দেন বা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না । সুতরাং, আপনাকে এথিকাল ট্রেডিং করতে হবে । এখন একটা রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হয় , তাহলে সে তার জনগণের কাছে একাউন্টেবল এবং জনগণের জন্য অনিষ্ট করে এমন কোন সিদ্ধান্ত , ব্যবসা করতে পারবে না । দুনিয়ার কর্পোরেট গুলা যতদিন রাষ্ট্রের অধীনে ছিলো , তারাও এই নৈতিকতা মেনে চলতে বাধ্য ছিলো । কিন্তু এখন মাল্টীন্যাশনাল কোম্পানি গুলা ধনে, সম্পদে , পলিটিকাল পাওয়ারে যে কোন একটি রাষ্ট্রের অধীনে নয় । আগে রাষ্ট্র কর্পোরেটকে নিয়ন্ত্রন করত। এখন কর্পোরেটই উলটা রাষ্ট্রকে চালায় । সুতরাং , ভোটের মাধ্যমে কে নির্বাচিত হবে , সেইটাও আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। মূলত পৃথিবীর সমস্ত ধন সম্পদ, পলিটিকাল ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রন চলে গেছে জনগণ তথা রাষ্ট্রের বাইরে , কতগুলা মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেটের হাতে । ন্যায়, নীতি , উচিত , অনুচিত বলে তাই আর দুনিয়াতে কিছু নাই । সবই প্রফিট ওরিয়েন্টেড । দুনিয়া জুড়ে যেই তথা কথিত এন জি ও , ডেভেলপমেন্ট, ডোনার , হেলথ , ডেভেলপমেন্ট এইড ইত্যাদি ইত্যাদি গাল ভরা নাম আর কার্যক্রম চলে , এইটাও আসলে কর্পোরেট বাণিজ্যেরই আরেকটা রুপ । নামেই নন প্রফিট , আসলে বিজনেস।

বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে ? কল্পনা করুন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীকে । এদের কত্তগুলা হাত আছে ?

ক। নন আর্মস , লিগাল ব্যবসার হাত
১। পলিটিকাল দল বা রাজনৈতিক ব্যবসার হাত
২। সম্পূর্ণ ফর প্রফিট ব্যবসার হাত - যেমন কম্পিউটার, ব্যাংক , প্রকাশনা
৩। প্রফিট - নন প্রফিট মিক্স সেবা খাত হিসেবে ধরা হয় এমন ব্যবসা - হাস্পাতাল, ইউনিভার্সিটি
৪। সম্পূর্ণ নন প্রফিট ( আসলে প্রফিট) ব্যবসা - এন জি ও
খ। আর্মড ও ইলিগাল ব্যবসার হাত
১। অস্ত্র চোরাচালান ও বিক্রি
২। মাদক এবং অন্যান্য অবৈধ পণ্যের বেচাবিক্রি
৩। আদম পাচার ইত্যাদি

এখন একটু চিন্তা করে দেখেন , এই সব কয়টা হাত মিলিয়ে জামায়াত কিন্তু বাংলাদেশের একেবারে গরীবের চেয়ে গরীব এবং উপরের ধনীর চেয়ে ধনী সব কয়টা স্তরেই ব্যবসা করছে । ক্ষুদ্র ঋণ থেকে শুরু করে ভার্সিটি, ব্যাংকিং, হাসপাতাল , তার উপরে ধর্ম ও পলিটিক্স । তার মানে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ হইলাম আমরা জামায়াতের ক্রেতা গোষ্ঠী এবং আমাদের শ্রম ও শ্রমের পয়সা চলে যাচ্ছে তাদের পকেটে । তাই রাজনৈতিক গ্রহনযোগ্যতা না থাকলেও জামায়াত গেড়ে বসেছে আমাদের গলার কাঁটা হয়ে , এবং এইটা ঘটেছে গত ৩০ বছরে । ঠিক এই ভাবেই কল্পনা করুন, বিশ্বের কয়েকটা মাত্র কোম্পানি এক এক করে কিনে নিচ্ছে অর্থনীতির সব কয়টা হাত । কি ঘটবে?

সারা বিশ্বই তখন পরিণত হবে একটা বাজারে যেইখানে সকলেই ক্রেতা বা কঞ্জিউমার । যে যত বড় বা বেশি কনজিউমার , তার দাম তত বেশি। আর সকল কার্যক্রমের মূলে রয়েছে শুধুই লাভ আর লাভ। লাভ নাই তো সব বন্ধ। এর ভিতরে লাক্সের চামড়া আসল কই থেকে , এইটাই ভাবছেন তো ?

পড়ুন২য় পর্ব

প্রথম পর্ব থেকে দুইটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ।
১। কর্পোরেট পুঁজিবাদ চালিত হয় একমাত্র লাভ বা প্রফিটের দ্বারা , এইখানে নিয়ম নীতি , উচিত -অনুচিত , এথিকাল - নন এথিকালের বালাই নাই

২। এই মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেট গুলো অর্থনীতির লিগাল, ইলিগাল, সোসাল - সব কয়টা হাত কিনে নিয়ে নিয়ন্ত্রন করছে ।

অর্থাৎ , যেই কোম্পানি মানুষের পয়সা চুষে খেয়ে ফুলে ফেপে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে , সেই আবার কর্পোরেট সোসাল রেস্পন্সিবিলিটির নামে সোসাল ওয়ার্ক করে বেড়াচ্ছে ।

মানে , ধরুন আপনার কাছে একটা গরু আছে । ঐটা দিয়ে আপনি দুধ উৎপাদন করতেন , নিজে খাইতেন , পরিবারকে খাওয়াইতেন আর বাড়তিটুকু বিক্রি করে সংসার চালাইতেন। এখন আমি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আপনার কাছ থেকে অনেক টাকায় গরুটা কিনে নিলাম । এবং দুধ আপনার কাছে বিক্রি করা শুরু করলাম , আপনিও কিনতে বাধ্য কারন আপনার নিজের আর গরু নাই। আপনি টাকার লোভে গরু বিক্রি করে দিলেও কিছু দিন পরেই ভুলটা বুঝলেন, টাকা তো চিরদিন থাকে না, খরচ হয়ে যাচ্ছে , কিন্তু তখন আর কিছু করার নাই । আপনার পয়সা ফুরায় গেলে আমার কাছেই হাত পাতলেন । আমি আপনাকে আমার মালিকানাধীন গরু যেইটা আগে আপনার ছিলো সেইটা দেখা শোনার দায়িত্ব দিলাম এমন বেতনে যেইটা দিয়ে বাচ্চা কাচ্চা দূরে থাক , আপনার নিজেরই এক গ্লাস দুধ জুটে না । এইবার আমি আমার কর্পোরেট সোসাল রেস্পন্সিবিলিটির নামে আপনারে দুধ কিনার ঋণ দিলাম। সেইটা দিয়ে আপনি নিজের বাচ্চার জন্য দুধ কেনা শুরু করলেন। আপনাকে বিক্রির কমিশন দেওয়ার লোভ দেখালাম ও ক্রেতা বাড়াতে বললাম। অচিরেই আপনি বুঝতে পারলেন , আয় না বাড়ালে ঋণ শোধ করা যাচ্ছে না । বাচ্চার লেখা পড়া বন্ধ হয়ে গেছে । আর আশে পাশের বাড়িতে যতদিন দুধ আলা গাভী থাকবে , আপনার বিক্রি বাড়বে না । আমাকে আর কিছু করতে হইলো না । বাঁচার তাগিদে আপনি আশে পাশে লোকজনকে গাভী বিক্রির জন্য মূলামূলি শুরু করলেন। ইতমধ্যে আমার লাভের টাকা দিয়ে আমি একটি স্কুল খুললাম । আমার কাছ থেকে স্বল্পসুদে ঋণ নিয়ে সেইখানে বাচ্চা কাচ্চারে পড়াতে শুরু করলেন। সেইখানে আমি তাদের আমার সুবিধা মত উচিত, অনুচিত, ভ্যালু শিক্ষা দিলাম । কিন্তু দিনে দিনে খরচ বেড়েই চলেছে , শেষে ভিটা মাটি বন্ধক পড়লো আমার কাছে । স্বভাবতই , আমি মহান । তাই আপনার বউকে নিয়ে এলাম , ট্রেনিং দিলাম ও একটা মিষ্টির কারখানা বানিয়ে তাতে কাজে লাগালাম। আগে ২২ টাকা লিটারের দুধ আমি নিতাম ২০ টাকা । আপনার বেতন ছিল ২ টাকা । মিষ্টির কারখানায় দুধ বেচে এখন পান ৪ টাকা (কমিশন সহ) । বউ এর বেতন ২ টাকা ( যেহেতু মেয়ে) । মিষ্টির কেজি ১৪০ টাকার ১৩৬ টাকা আমার । ভুলে যাবেন না , আপনার ৬ টাকা থেকে আমাকে কিস্তি দিতে হয় কিন্তু । ধরে নেই , কিস্তি ২ টাকা । সেখান থেকে আমি রাখি ১ টাকা । বাকি ১ টাকা দেই আপনার ছেলেকে যে মাসে মাসে কিস্তির টাকা আমাকে এনে দেওয়ার কাজ নিয়েছে আমি যেই নতুন ব্যাংকটা খুলেছি সেইখানে। ইতমধ্যে আপনার মেয়ে স্কুল পাশ দিয়েছে । আমি তাকে ট্রেনিং দিয়ে পোল্ট্রির কাজে লাগিয়েছি যেইটা আপনার আগের ভিটায়/ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত । শিক্ষিত বলে তার বেতন আড়াই টাকা । চাইলে অবশ্য সে ঋণ নিয়ে আমার পোল্ট্রির মুরগীগুলাকে বেচার ব্যবসা করতেই পারে। এই রকম ভয়ানক পরিশ্রমের ফলে অসুখ বিসুখ হইতেই পারে । তাই আমি একটা হাসপাতাল দিয়েছি । সংস্থার কর্মী হিসেবে ঐখানে আপনি ৩০% ডিস্কাউন্টে চিকিৎসা পান। এর ভিতরে এলাকায় ইলেক্ট্রিসিটি নিয়ে এসেছি। আমার নতুন গার্মেন্টস আর বিড়ি সিগারেটের কারখানাইয় আপনার আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শীরা কাজ করে , যাদের গরু গুলোকে আপনিই তাদের প্রলব্ধ করেছিলেন আমার কাছে বেঁচে দিতে । এরাই আবার আমার মিষ্টি, কাপড় , বিড়ি, শিক্ষা , চিকিৎসা ইত্যাদির ক্রেতাও ।

এই গল্পটা থেকে ৩টা জিনিস শিখবেন ।

১। আপনার বেতন যতই বাড়ুক, আপনি কোনদিনই আমার মতন বড়লোক হইতে পারবেন না , আর ১৪ জেনারেশন ধরে চেষ্টা করেও পুরাপুরি ঋণ মুক্ত হইতে পারবেন না । শুভংকরের ফাঁকিটা ঐখানেই ।

২। আপনার বেতন আমি তখনই বাড়াব যখন আমার উৎপাদিত পণ্যের ক্রেতা বাড়ানোর জন্য একটা নির্দিষ্ট ক্রয় ক্ষমতা সম্পন্ন কনজিউমার বাজার লাগবে ।

৩। আগে আপনি ও আপনার আশে পাশের সবাই গরু নামক একটি উৎপাদক যন্ত্রের মালিক ছিলো । আজকে আমি হইলাম মালিক আর আপনারা সবাই আমার ইচ্ছার অধীন , উচ্চ বেতন সম্পন্ন , মাল্টিন্যাশনালে কর্মরত গর্বিত কর্মী । পাশাপাশি আমার ক্রেতা।আপনে যতই উপরে উঠেন, আমি মালিক, আপনি আমার চাকুরে/চাকর


এর নাম কর্পোরেট বাণিজ্য । আমি আপনাকে প্রতি পদে পদে ঠকাচ্ছি , ঠকিয়ে নিজে লাভ করছি । প্রথমে ঠকাচ্ছি বেশি দামে গরু বিক্রির লোভ দেখিয়ে ( অনেক বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন) , তারপর বেতনে , তারপর ঋণে , তারপর সুদে , তারপর ডিস্কাউন্ট দেওয়ার নামে উৎপাদিত পণ্যের বান্ধা কাস্টমার বানিয়ে , এবং পরিশেষে আপনাকে চিরদিনের জন্য ঋণে বেধে ফেলে ।

আপনার গরু , আপনার গরুর দুধ এখন একবার দুয়ানোর জন্য শ্রম দিবেন, তারপর কেনার জন্য শ্রম দেবেন , তারপর বেঁচার জন্য শ্রম দিবেন । সুতরাং, কইয়ের তেলে কইই শুধু ভাঁজছি না আমি , একটা মাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাঝে আমি আপনাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধাপে শোষন ও করছি ।

শুরুতে এই কর্পোরেট নামক শোষক যন্ত্রটি ছোটই থাকে । আস্তে আস্তে এরা গ্রাস করে নেয় খাদ্য , বস্ত্র, বাসস্থান , শিক্ষা , চিকিৎসা, বিনোদনের মত মৌল চাহিদা মেটানোর সব কয়টা উৎপাদনের উপকরণ ।

এখন এই গ্রাস তারা কেমনে সম্ভব করে? কিছু দিন আগেও প্রধান তরিকা ছিলো যুদ্ধের মাধ্যমে দখল ও সরাসরি শোষণ। যেমন, বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত শাসন। কিন্তু এতে দেখা গেলো দুই দিন পর পর, খালি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে দেয় ফাউল পোলাপাইন । এইবার নতুন তরিকা । সেই ম্যাট্রিক্স ছবিটার মতন সবাইরে ঘুম পাড়ায় রাখো । তুমি মনে করবা তুমি স্বাধীন , বাস্তবে স্বাধীন না । ঠিক এই কাজটাই এখনকার মাল্টিন্যাশনাল বিজনেস ওয়ার্ল্ড করে থাকে যার নাম মার্কেটিং ( আসলে ব্রেইন ওয়াশিং) । তা মার্কেটিং কাকে বলে ?

মার্কেটিং হলো সেই প্রক্রিয়া যা আপনাকে কিনতে বাধ্য করবে এমন একটা বস্তু যা আপনার কোন কালেই দরকার ছিলো না এবং অবশ্যই উৎপাদনের দশগুণ দামে ।

এখন এই মার্কেটিং এর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হইলো মিডিয়া । ২৪ ঘন্টা যেই মিডিয়া আমাদেরকে কিছু ভ্যালু বা মূল্যবোধ শিক্ষা দেয় । আপনারা হয়ত ভাবতে পারেন আপনার উপরে মিডিয়ার কোন প্রভাব নেই । কিন্তু মাথা ঠান্ডা করে খুব সূক্ষ ভাবে চিন্তা করলেই দেখবেন , আজকের মিডিয়া আমাদেরকে কি দেয়? তথ্য ? বিনোদন ? নাকি শিক্ষা ?

কোনটাই না ।

মিডিয়া আমাদেরকে দেয় অর্থ বা মিনিং । প্রতিটা মানুষেরই মূল তিনটা প্রশ্ন থাকে , আমি কে , আমি কি এবং আমি কেন ? আমরা বেশির ভাগই হন্যে হয়ে এই প্রশ্ন গুলার উত্তর খুঁজে বেড়াই আর মাল্টি কর্পোরেশনের মার্কেটিং বিভাগ ঠিক এই উত্তর গুলাই তাদের সুবিধামত আমাদের সামনে হাজির করে । লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতা এই কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের বাণিজ্যের সাথে এই ভাবেই জড়িত । তারা প্রতিনিয়ত ঠিক করে দিচ্ছে , বাংলাদেশের একজন নারী কে? কি এবং কেন ?

লাক্সের বিজ্ঞাপন অনুযায়ী ,

কে? - আমি একজন সুপারস্টার
কি? - অন্যদের চেয়ে অনেক অনেক উপরে, অনেক বেটার
কেন? - কারন আমি বিশেষ একটি ইমেজ যাপন করি

লক্ষ্য করে দেখুন, একটা মানুষের আত্মপরিচয়, অস্তিত্বের মাপ কাঠি এবং জীবন যাপনের উদ্দেশ্য বিধেয় লাক্স ঠিক করে দিচ্ছে । লাক্স আমাদের ব্রেইন ওয়াশ করে এইটা প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে যে একটি নির্দিষ্ট চেহারা , নির্দিষ্ট কিছু স্কিল (নাচ, ক্যাট ওয়াক, শপিং , দেহের মাপ ধরে রাখা ইত্যাদি) আমাদেরকে মানুষ হিসেবে অন্যদের চেয়ে বেশি দামী করে তুলবে । এবং আমরা তখন সুপারস্টার হয়ে যাব । আর সুপার স্টার হলেই আমরা মানুষের ভালোবাসা , সম্মান, প্রতিষ্ঠা , সাফল্য পাব। সেই সাফল্যের সংজ্ঞা , সেই ভালোবাসা পাওয়ার তরিকা বাতলে দিতে পারে কেবল লাক্স আর চ্যানেল আই।

আমাদের , বাংলাদেশের ২০০০ বছরের সংস্কৃতি , প্রাচ্যের দর্শন , জীবন বোধ কি বলে? আমরা কি সাফল্যের এই সংজ্ঞায় অভ্যস্ত? আমাদের হাজার বছরের জীবন ভাবনা আমাদের এতদিন শিখিয়েছে ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। মাত্র দুটি কাপড়েই জীবন ভালো ভাবে চলে যেতে পারে। অল্প খাও কিন্তু খাঁটি খাও । কিছুদিন আগে পর্যন্তও বেশি শুকনা মেয়েদের বিয়ের সমস্যা হইত কারন আমরা একটু স্বাস্থ্যবতী বউ পছন্দ করতাম। সৌন্দর্য্যের মাপ ছিল সাদামাটা টানা টানা কাজল কালো চোখ আর খোঁপায় বেলী ফুলের মালা। টিভি মিডিয়ার বদৌলতে আমরাও শুকনা ভালোবাসতে শিখেছি । এখন ক্যাট্রিনা হইলো আদর্শ । আমাদের ভ্যালু বদলাচ্ছে । আমরা চাই আর না-ই চাই , আমাদের আদর্শ বদলে যাচ্ছে । শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বের মানুষের মাথায় হাতুড়ি পিটা করে শিখানো হচ্ছে , ক্যাটরিনা মানে সাফল্য , ক্যাটরিনা মানে আদর্শ । যার সব টুকুই মিথ্যা আর ভয়াবহ রকমের প্রেজুডিসড, রেসিস্ট , পাশবিক।

এখন প্রশ্ন হইলো সারাজীবন মাল্টিন্যাশনালে চাকরী করে আমরা সবাই কি মাল্টিন্যাশনালের মালিক হইতে পারবো ?

সারা জীবন লাক্স , চ্যানেল আই এর সাথে গা ঘষাঘষি করলেই কি আমরা সবাই সুপারস্টার হইতে পারবো?

এখন এই -গ্ল্যামারই জীবনের সাফল্যের মাপকাঠি- ধরনের ব্রেইন ওয়াশে দর্শকের দেহকামনা , ধর্ষকামী ভূতের আছর আসলো কেন? এদের ভূমিকাই বা কি?

পড়ুন ৩য় পর্ব । 

১ম ও ২য় পর্ব থেকে যদি সার সংক্ষেপ কিছু নিতে চান তাহলে নিচের উপলব্ধি গুলো গুরুত্বপূর্ণ ।

১। আজকের বিশ্বে কর্পোরেট দুনিয়া আমরা কি খাব, কি পরবো, কি রকম বাড়িতে বাস করবো, কি ধরনের মূল্যবোধকে দাম দেব, কিসে বিনোদিত হবো , কাকে বিয়ে করবো , কোন অবস্থানকে জীবনের সাফল্য আর কোনটাকে জীবনের ব্যর্থতা হিসেবে মানবো - এই সব কিছুই ঠিক করে দেয় । ( কারন, একই মালিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , সেবা খাত আর পলিটিকাল দলকে চালায়)

২। এই কর্পোরেট দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হইলো মিডিয়া । বিশেষ করে মাল্টি মিডিয়া যা প্রতিনয়ত এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এর সুবিধা ও লাভ অনুযায়ী আমাদের ভ্যালু সিস্টেম ( কিসের মূল্য কত টুকু) , আমাদের কালচার, আমাদের জীবন দর্শনকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে । যা কিছু ব্যবসার সহায়ক তাকে উৎসাহ দিচ্ছে , যা কিছু ব্যবসার পথে প্রতিবন্ধক তাকে খারাপ বলে শিক্ষা দিচ্ছে ।

৩। এইটা করাটা খুব বেশি জরুরী কারন মানুষ যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করা শুরু করলেই এই দানব মাল্টিন্যাশনাল গুলা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে । আরো একটা কারণে এই মিডিয়ার প্রচার প্রয়োজন কারণ , পুঁজিবাদ বেঁচে থাকার জন্য একটা কাজ প্রতিনিয়ত করে তা হলো প্রফিট । অর্থাৎ , প্রফিট বা লাভ ছাড়া পুঁজিবাদী মার্কেটিং সিস্টেম বাঁচতে পারে না । এইটা কোন সেলফ সাস্টেইনেবল সিস্টেম না বরং সেলফ ডিস্ট্রাক্টিভ সিস্টেম। ক্রমাগত বাড়তে না পারলে পুঁজিবাদী মার্কেট ভেঙে পড়ে ।

একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝাই । আগের পোস্টের গরুটাকে মনে আছে ? ওই যে , লাভ করার জন্য আপনি পাড়াপ্রতিবেশীকে গাভী বেচে দেওয়ার জন্য ছল, বল ও কৌশল ব্যবহার করলেন? এখন এই পুরা উৎপাদন প্রক্রিয়াটিতে কর্পোরেট পুঁজিবাদ লাভ করে দুই ভাবে । এক হলো , শোষন ( শ্রম শোষণ) , আর ২য় হল উৎপাদনের বেশি দামে বিক্রি ।

কর্পোরেট বাণিজ্য-তে আপনার গরু (ছিলো), আপনার গরুর দুধ এখন একবার দুয়ানোর জন্য ( আমি কিনে নেওয়ার পর) শ্রম দিবেন, তারপর কেনার জন্য শ্রম দেবেন , তারপর বেঁচার জন্য শ্রম দিবেন । সুতরাং, কইয়ের তেলে কই-ই শুধু ভাঁজছি না আমি , একটা মাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাঝে আমি আপনাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধাপে শোষনও করছি ।

২য় পদ্ধতিতে লাভ করতে হলে চাই বিক্রি । বিক্রি করতে হলে চাই ডিমান্ড । ডিমান্ড ক্রিয়েট করতে হলে চাই নতুন নতুন বাজার বা কঞ্জিউমার / ক্রেতা। মানে, বাজারে সকল ক্রেতার কাছেই যদি দুধ থাকে তাহলে আমার দুধ আর বিক্রি হবে না । সুতরাং হয় আমাকে,

১। সকলের দুধ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে (স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ডিমান্ড তৈরী)
২। নাইলে নতুন ক্রেতা খুঁজে নিতে হবে ( নতুন ক্রেতা মানে নতুন ডিমান্ড)
৩। বা মানুষের দরকার থাকুক আর নাই থাকুক , ক্রেতাকে দিয়ে যে কোন মূল্যে দুধ কেনাতে হবে । ( কৃত্রিম ডিমান্ড বা মিথ্যা ডিমান্ড তৈরী)

আমাদের লাক্স কিংবা চ্যানেল আই বাঁচে এই ৩য় প্রকার ডিমান্ড তৈরী করার মধ্য দিয়ে । প্রসাধন জীবন ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় না । যেমন জরুরী না টিভি দেখা । এমন কি খাদ্য কিংবা জীবন্রক্ষাকারী ওষুধ এর মত জরুরী পণ্য হলেও যদি তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে উৎপাদিত হয় (মার্কেট স্যাচুরেশন করে ফেলে, যেমন পানিতে লবণ ঢালতে ঢালতে এক সময় যখন পানি আর লবণ নিতে পারে না) অথবা দাম বেশি বলে ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন কর্পোরেট পুঁজিকে দৌড়াতে হয় নতুন ক্রেতা ধরতে - থাকলে খুঁজে নাও , না থাকলে বানাও ।

বিল গেটস শিক্ষা দীক্ষা নিয়ে আকুল হইতেন না; যদি না কম্পিউটার কেনার জন্য এবং ব্যবহারের জন্য একটা নির্দিষ্ট লেভেলের শিক্ষা, দরকার না হইত ।

এখন পৃথিবীর সকল জায়গায় কোন দুইটা জিনিসের ডিমান্ড চিরকাল থাকবে , যতদিন মানুষ থাকবে , ততদিন থাকবে?

১। খাদ্য । যেইখানেই জীবন থাকবে সেইখানেই ক্ষুধা থাকবে।

২। সেক্স । যেইখানেই মানুষ থাকবে , সেইখানেই সেক্স থাকবেই ।

লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার এই দ্বিতীয় বাজারটির কারবারী । কি করতে হবে? সুন্দর হইতে হবে । কেন সুন্দর হইতে হবে? সুন্দর হইলে সুপারস্টার হওয়া যাবে । কেন সুপারস্টার হইতে হবে? সুপারস্টার হইলে সেক্সের বাজারে দাম বাড়বে ( সেই সেক্স বিবাহের বাইরেই হোক আর ভিতরে ) । এর সাথে আনুসাঙ্গিক হিসেবে টাকা, প্রভাব, খ্যাতি - কে না চায় এই সব?

কি ভাবে মিথ্যা ডিমান্ড তৈরী করে টিভি মিডিয়া ?

আমাদের চাওয়া এবং প্রয়োজনের বোধকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করে দিয়ে।

হাত ধোয়ার সাবানের মার্কেট শেষ । তাইলে সাবান এখন কেন দরকার? সুন্দর হওয়ার জন্য । শীত বা গরম ও লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য যতটুকু কাপড় মানুষ এর দরকার হয় , এখন তার চেয়ে অনেক বেশি কাপড় উৎপাদিত হয় । তাই কি দরকার ? ফ্যাশন । বিউটি সোপ আর ফ্যাশনেবল কাপড় এ বাজার ছেয়ে গেছে । তাইলে এখন কি দরকার ? এখন দরকার সুপারস্টার হওয়া ।

আসেন দেখি কর্পোরেট পুঁজিবাদ ইউনিলিভার কি ভাবে এই ফলস ডিমান্ড তৈরী করে?


বিশ্ব ব্যাপী সুন্দরের যেই সংঙ্গা কর্পোরেট গুলা তৈরী করেছে , তার মূলে আছে মানুষের অদম্য কামনা । যা মানুষ হতে পারবে না কোন দিন -তাকেই আদর্শ হিসেবে সেট করে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মিডিয়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে । কি রকম?

১। আফ্রিকা ও এশিয়ার উপমহাদেশে সারাক্ষণ প্রচার হচ্ছে ফর্সা হউন।
ইউরোপ ও আমেরিকায় সারাক্ষণ প্রচার হচ্ছে , কালো (ট্যান) হউন।

২। কালো চুলের মেয়েদের সারাক্ষণ দেখানো হচ্ছে , কালোদের স্ট্রেইট চুলে বেশি ভালো লাগে। আর যাদের চুল এম্নিতেই স্ট্রেইট , সেই সাদাদের দেখানো হচ্ছে কোকড়া চুল বেশি সেক্সি ।

৩। শুকনা মেয়েদের - তোমার বড় বুক নেই । মোটা মেয়েদের - তোমার চিকন কোমর নেই।

৪। খাট পুরুষদের - লম্বা হউন। লম্বা পুরুষদের - মাস্কুলার হউন। মাস্কুলার পুরুষদের - যৌণ শক্তি বাড়ান।

মানে , আপনি ফর্সা, কালো, খাট - লম্বা, চিকন - মোটা - যাই হোন না কেন , আপনার শান্তি নাই । আপনি কিছুতেই সেক্সের যোগ্য না । প্রেমের যোগ্য না। ভালোবাসার যোগ্য না। সম্মানের যোগ্য না । আপনি কিছুতেই সফল না না না না না, যতক্ষণ না তাদের পণ্যটি ব্যবহার করছেন । আমি যতই বলি আপনি পারফেক্ট , আপনি বিশ্বাস করবেন না , কারণ মিডিয়া আপনাকে সারাক্ষণ শিখাচ্ছে , আপনি পারফেক্ট নন। ইউ নিড মোর । মোর মানি।মোর সেক্স । মোর মোর মোর ।

এই ঝামেলায় কি খালি মেয়েরাই? নাহ। নিঃসন্দেহে মেয়েরা তাদের দেহ এবং রুপ দিয়ে বিচার্য হয় বলে ৯০% টার্গেট মেয়েদের শরীর । ত্বক, বুক, নিতম্ব, মুখমন্ডল - আমাদের সমস্যার অন্ত নেই আর কোম্পানি গুলার সমাধানেরও অন্ত নেই । কিন্তু ছেলেরাও কম ঝামেলায় নেই । ৪২ ইঞ্চি ছাতি , ব্র্যাড পিটের নিতম্ব আর সিক্স প্যাক না হইলে চলবে না । এদিকে আবার দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী পুরুষ গুলা সব ভুড়িয়াল , তাতে কি? সব কয়টা নোবেল প্রাইজ উইনারও অতি সাধারন দেখতে, তাতে কি? অবশ্য পুরুষের সাফল্য মানে সাধারণত দেহ নয়, কাড়ি কাড়ি টাকা । সোজা ভাষায় যা আপনি হইতে পারবেন না ( বায়োলজি, ইকোনমি কিংবা সোসাল কারনে), তা হইতে উদ্বুদ্ধ করাটাই হইলো মার্কেটিং , ব্রেইন ওয়াশিং এর কাজ ।

অতএব লাক্স এবং চ্যানেল আই এর কাজ হইলো বঙ্গবাসীকে আগে এইটা শিখানো ,

হোয়াট ইজ সেক্সি? ( উত্তর অতি অবশ্যই লাক্স সুন্দরী। এইটা তো লাল সালুর ব্লগে প্রমান হয়েই গেছে যে লাক্স এই কাজে পুরাপুরি সফল হয়েছে )

এই জন্য চোখ , ঠোঁট আর ভঙ্গিমায় আবেদন খুঁজে বেড়াইলেন আমাদের দাদু শামসুল হক ।

পরের ধাপ হইলো ,

হু ইজ সেক্সি ? ( উত্তর অতি অবশ্যই যারা লাক্স সুন্দরীদের মত দেখতে, চলনে, বলনে ইত্যাদি । এইখানেও তারা সফল)

এর পরের ধাপ, মানে আসল ধাপ , আপনি কিভাবে সেক্সি হবেন? ( লাক্স , জগৎজোড়া বিখ্যাত কোম্পানির প্রসাধন ব্যবহার করতে হবে )

প্রথম পোস্টের কথা মনে আছে ? ঐ যে বলেছিলাম , একই কর্পোরেট অঙ্গের বিভিন্ন ব্যবসার হাত? মিমি কাপড়ের ব্যবসা, সুবর্ণা এ্যাড মেকার , শামসুল হক চিত্রনাট্য লেখক । তাহসিন, ইষানা , মেহজাবিনরা পণ্য নন , পণ্যের বিক্রেতা । এরা একই কর্পোরেট বাণিজ্যের এক একটি অনুসঙ্গ । সকলেই একটি মাত্র উৎপাদন থেকে বিক্রি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত !

দর্শকদের দেহ কামনাঃ

আগেই বলেছি , যেখানেই মানুষ থাকবে সেইখানেই সেক্স থাকবে। হয় প্রকাশ্যে নয় গোপনে। এইটা মানুষের মৌলিক চাহিদা । এর ডিমান্ডের শেষ নাই । তাই সাপ্লাইএর ও শেষ নাই। যারা " মা বোনেরা বেশ্যা হয়ে গেলো " বলে বোল তুলেছে তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, ২০০০ বছর আগেও বঙ্গে বেশ্যালয় ছিল। তখন লাক্স চ্যানেল আই ছিলো না । কিন্তু আমার-আপনার বাপ, ভাইয়েরা ছিলো বলে ডিমান্ড ছিলো । তাই সাপ্লাইও ছিলো । ইট ইজ দ্যাট সিম্পল। লাক্স চ্যানেল আই ডিমান্ড তৈরী করছে না । তৈরী হয়ে থাকা ডিমান্ড নিয়ে ব্যবসা করছে শুধু ।

সেক্স হলো বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্য । হয় সেক্স , না হয় সেক্সুয়ালিটি। ৪ বিলিওন মানুষ এর ক্রেতা অথবা বিক্রেতা ( এক তৃতীয়াংশ মানুষকে শিশু ধরে নিয়ে বাদ দিলাম) সারা বিশ্ব জুড়ে । তাহলে বুঝেন এর ডিমান্ড কেমন?

লাক্স, ইউনি লিভার এর নতুন করে ডিমান্ড তৈরী করার দরকারই নাই , দরকার শুধু এই ডিমান্ডের সাথে তাদের পণ্য গুলাকে এলাইন করা , আমাদের বুঝানো যে তাহাদের পণ্য , মাখিলেই বন্য!

তার মানে কি তারা নারীকে পণ্য করছে না? অবশ্যই করছে । শুধু নারী কেন, তারা পুরুষ ও বাচ্চাদেরও পণ্য করছে । কেন খেয়াল করেন নাই? ২০০০ বছরে হয় নাই , আজ কাল হঠাৎ করেই বাচ্চাদের ত্বক শুষ্ক আর খসখসে হয়ে উঠেছে ? যেই দিন থেকে লাক্স বেবি লোশন ক্রিম নিয়ে মাঠে নেমেছে সেইদিন থেকে আমাদের শিশুরা ত্বকের আর্দ্রতা হারাচ্ছে ?

আগেই বলেছি , নতুন ক্রেতার বাজার তৈরী করতে না পারলে এই সর্বগ্রাসী প্রফিট ওরিয়েন্টেড কর্পোরেট পুঁজিবাদ বেঁচে থাকতে পারে না । মা বোনের , কিশোর কিশোরীদের মার্কেট স্যাচুরেটেড হয়ে গেছে , এখন তাই বাচ্চার চামড়া দরকার , ব্যবসার জন্য !


আমি খুবই দুঃখিত, এই পর্বেও শেষ করতে পারলাম না । পরের পর্বে আশা করি শেষ করতে পারবো ।

পড়ুন শেষ পর্ব । 

আগের পর্ব গুলা থেকে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে,

১। যেই কর্পোরেট বাণিজ্য গুলাকে আমরা ভিন্ন ভিন্ন সেক্টর , ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা বলে মানি , সেই গুলো হতেই পারে একই বাণিজ্যিক মালিকের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা (গরু কাহিনী)। আর যদি তা নাও হয় , তারপরেও তারা একই প্রোডাকশন লাইনের ( এন্টারটেইন্মেন্ট মিডিয়া) বিভিন্ন পর্যায়ে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এবং সার্ভাইভালের জন্য একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল। অর্থাৎ , মিমির কাপড়ের ব্যবসা সুবর্ণার নাটকের উপর , সুবর্নার নাটক হকের লেখার উপর, হকের নাটকের প্রচার ইউনিলিভারের বিজ্ঞাপনের উপর, ইউনিলিভারের বিজ্ঞাপন ফুয়াদের জিঙ্গেলের উপর , ফুয়াদের জিঙ্গেল পণ্যের মডেলের উপর এবং পণ্যের মডেল দর্শকের সেক্স ও সেক্সুয়ালিটির উপরে নির্ভরশীল। এই সম্পর্কটি লিনিয়ার নয় বরং মাকড়সার জালের মত ইন্টারকানেক্টেড।

২। এনটারটেইনমেন্ট মিডিয়ার কর্পোরেট দুনিয়া নিজেদের এবং পৃষ্ঠপোষক ( এবং শোষক) ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাভের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রতিনয়ত এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলার সুবিধা ও লাভ অনুযায়ী আমাদের ভ্যালু সিস্টেম ( জীবনের কোন জিনিস, কোন শিক্ষা , কোন অনুভূতি সবচেয়ে মূল্যবান , তুলনামূলক ভাবে কিসের মূল্য কত টুকু) , আমাদের কালচার, আমাদের জীবন দর্শনকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করে। যা কিছু ব্যবসার সহায়ক তাকে উৎসাহ আর যা কিছু ব্যবসার পথে প্রতিবন্ধক তাকে খারাপ বলে শিক্ষা ব্রেইন ওয়াশ করতে থাকে।

৩। এইটা করাটা খুব বেশি জরুরী কারন মানুষ যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করা শুরু করলেই এই দানব মাল্টিন্যাশনাল গুলা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে ।

গরু কাহিনীতে ফেরত যাই । মনে করুন, হঠাৎ একদিন আপনার প্রতিবেশীরা ঘুম থেকে জেগেই উপলব্ধি করলেন , তাদের গরুগুলো ( উৎপাদনের যন্ত্র ) যেদিন থেকে হাতছাড়া হয়েছে , সেদিন থেকেই তারা আমার দাসানুদাস হতে শুরু করেছেন। এই উপলব্ধি হলে তারা কি আমাকে ছেড়ে কথা বলবেন ? আন্দোলন করে ফাটিয়ে দেবেন না ?

নাহ ।

ভুলে গেছেন , আমার কাছে গরু বেচতে আমি বলিনি , বলেছেন আপনি ! একটু অনুসন্ধান করে এই সত্যও বের করা কঠিন না যে নিজের দুধের বিক্রি বাড়ানোর জন্যই আপনি এই ছলের আশ্রয় নিয়েছিলেন । ফলে মানুষ লাঠি নিয়ে পিটা লাগাবে আপনাকে । আর আমি? আমার কিছুই হবে না । এলাকায় স্কুল, হাসপাতাল, ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকারী আমি প্রেস কনফারেন্স করবো , " এই দেশের কোন এবিলিটি নাই। পলিটিকাল স্ট্যাবিলিটি নাই। আমি চললাম মালয়শিয়া , ওরা আমার মুসলিম ভাই !" দেশের একজন বিশিষ্ট ইনভেস্টরকে তাড়ানোর জন্য আপনি ও আপনার প্রতিবেশীরা পিটা খাবেন এরপর । দয়া পরবশ হয়ে আমি ব্যবসা গুটিয়ে ( বিক্রি করে) চলে যাওয়ার আগে সেই বুড়া গরুগুলিকে
১০ গুণ দামে আপনাদের কাছেই বিক্রি করে দিব , আন্দোলন থেমে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে । আমি মহান রয়ে যাব। ( গরুর জায়গায় কৃষি জমি কিংবা অন্য যে কোন উৎপাদন্মুখী খাতকে বসিয়ে নিতে পারেন। )

এখন কথা হইলো , এই হঠাৎ করে জাগার কারন কি? মালয়শিয়া যদি বুঝে আপনারে খেপাইলে ব্যবসা তার দ্বারে যাবে তাইলে মালয়রা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে আপনার জ্ঞানচক্ষু খুলার জন্য " দা ইভিল অফ ক্যাপিটালিজম" ক্লাস নিবে। তবে , আপনি আমার কাছে গরু বিক্রির আগে না , অবশ্যই পরে।

যে সময়টা জেগে উঠলে আপনার লাভ , সেই সময়ে চক্ষু খুলার একটাই উপায়, তা হলো শিক্ষা ও জ্ঞানের চর্চা। সারা দুনিয়া জুড়ে কে কি কেন করছে , সেই পলিটিকাল জ্ঞান থাকা। স্বচ্ছ ও অবাধ তথ্যের আদান প্রদান ও সেই তথ্যের মিনিং বুঝার জ্ঞান । আমেরিকা ইরাক আক্রমন করেছে - এইটা তথ্য । আমেরিকা ইরাক থেকে তেল নিবে বলে আক্রমন করেছে হইলো জ্ঞান । আর তেলের পাইপ লাইন টানার জন্য আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে ডিক্টেটরশীপ গুলাকে পয়সা দিয়ে পালছে- এইটা হইলো মিনিং । আমি মালয়শিয়া পালানোর আগেই আমাকে ধরতে হলে কিংবা ঠেকাতে হলে এই মিনিংটা বুঝতে হবে ।

লাল সালুর আক্রমনের টার্গেট মেয়ে গুলা , বড় জোর বিচারক । তার পিছনে চ্যানেল আই না । চ্যানেল আই এর পিছনে লাক্স না। লাক্সের পিছনে ইউনিলিভার না। আগেই বলেছি , লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার জাতীয় প্রতিযোগিতা গুলো সেক্সের ডিমান্ড তৈরী করে না । যে ডিমান্ড সমাজে তৈরী হয়েই আছে , অত্যন্ত সুস্থ এবং স্বাভাবিক জৈব চাহিদা হিসেবেই আছে , তাকে ব্যবসার খাতিরে ব্যবহার করে, উস্কে দেয় । ছেলেদের ধরে ধরে সুড়সুড়ি দেওয়াই যে এর মূল উদ্দেশ্য ঠিক তা না , তবে অস্থির করলে এই বেনিয়াদেরই লাভ। পণ্য বিক্রি ও পণ্যের বিপণণ আসল উদ্দেশ্য হইলেও সমাজকে বিশেষ করে তরুন সমাজকে অস্থির করে রাখলে এই বেনিয়াদের যেই লাভটা হয় তা হলো , অস্থির মানুষ চিন্তা ভাবনা করে কম। ক্রিয়া করে কম, করলেও সেইটা রতিক্রিয়াই হবে, তবে রতিক্রিয়ার চেয়েও অনেক বেশি করে প্রতিক্রিয়া। কোন কিছু নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করতে চাইলে চাই শান্ত মন। সুস্থির বিবেক। চাই যুক্তি ও জ্ঞানের সঠিক সম্মেলন। কিন্তু এই সুড়সুড়ি মার্কা প্রতিযোগিতাতে অস্থির যুবকরা অস্থির হয়ে উঠে তাদের প্রতিবাদের ভদ্র ভাষাটাও ভুলে যায় । লাল সালুর ব্লগ পোস্টে তার স্পষ্ট প্রমান আছে । অস্থির , অসংলগ্ন মানুষকে প্রভাবিত করা বা ব্রেইন ওয়াশ করা অনেক সোজা। সুতরাং তুমি লাক্স কেনো আর নাই কেনো , মানুষ যত অস্থির , তত প্রতিক্রিয়াশীল, যত প্রতিক্রিয়াশীল তত দুর্বল , যত দুর্বল ততই সহজ তার কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রন করা ।

এই জন্যই সুস্থির , চিন্তাশীল সমাজ ও সামাজিক জীবন পুঁজিবাদের পছন্দ না । পুঁজিবাদের চাই অস্থির গতি , আরো আরো আরো গতি ! মানুষ সারাক্ষণ ছুটবে । হয় রোজগার নেই বলে ছুটবে , নয়ত রোজগার আছে বলে ছুটবে। আর খাবে । কামাবে আর খরচ করবে। মুখ দিয়ে খাবে । চোখ দিয়ে খাবে । মন দিয়ে খাবে। স্পর্শে খাবে, গন্ধে খাবে , চিন্তা চেতনায় খাবে । এই গ্রহন গুলো থেকে সে কিছু অর্জন করবে না , স্রেফ হজম করবে । কিছুই চিন্তা করবে না , পাগলের মত চ্যানেল ঘুরাবে , ছাগলের মত ফাস্ট ফুড চিবাবে , উঠতে বসতে ছটফট করে বেড়াবে - তাইলেই লাভ, লাভই লাভ!

চিন্তাশীল মানুষ নিজের বিপদ টের পায় সবার আগে । অস্থির মানুষ টের পায় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। এখন তাই ফাস্ট এর জয় জয়কার সারা মিডিয়া জুড়ে । শিল্পী ( স্লো পদ্ধতি ) চাই না, স্টার (ফাস্ট) চাই। ফাস্ট ফুড , ফাস্ট সেক্স , ফাস্ট লাইফ !

কারন যেই মুহুর্তে আপনি চিন্তা করতে শুরু করবেন , আরেকটা সিম কেন কিনবো? কি লাভ? আরেকটা গাড়ি কেন লাগবে? ইষানা কেন, কুলসুমও তো সুন্দরী ! ৮০০ টাকা দিয়ে চিকেন ফ্রাই কেন খাব , বাসাতে ১২০ টাকা দিয়ে নিজেই বানাতে পারি তো! ক্যাটস আই এর শার্ট লাগবে কেন? শার্ট তো শার্টই ! - সেই মুহুর্ত থেকে আপনি পুঁজিবাদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠলেন ।

পুঁজিবাদ চিন্তাবিদ চায় না। চায় ক্রেতা । যে খালি কিনবে আর কিনবে । আসলেই দরকার আছে না নাই, এই সব ভাববে না । তাকে শেখানো যাবে - বিজ্ঞাপন বলেছে দরকার , তাই দরকার!

পুঁজিবাদের সবচাইতে বড় শত্রু তাই কমিউনিজম নয় , সোসালিজম নয় । পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় শত্রু সচেতন , চিন্তাশীল মানুষ যা তাকে যুক্তিবাদ ও র‌্যাশনাল কেনা বেচা লেন দেন শিখায় । পুঁজিবাদের বড় শত্রু প্রাচ্যের জীবন দর্শন যা মানুষকে নির্লোভ ও আত্মত্যাগী ও সংযম শিক্ষা দেয় । যা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় , অন্যের ক্ষতি করে নিজে লাভবান হওয়াটা লাভ নয়, ক্ষতি । ঠিক একই কারণে পুঁজিবাদ এর বড় শত্রু ইসলাম । কারন, ইসলাম বলে দুনিয়াতে এত কেনাকাটার দরকার নাই , আখিরাতেই সব কিছু পাবা । ( আরব আমিরাতের ইসলাম না , আমাদের উপমহাদেশের সুফিবাদী , আত্মত্যাগী , নির্লোভ ও অল্পে সন্তুষ্ট জীবন দর্শন ধারী ইসলাম যেই দর্শনের দেখা পাওয়া যায় উপমহাদেশের হিন্দু ও বৌদ্ধ বিশ্বাসেও। ) পরকালের সুখের জন্য ইহকালে ত্যাগী জীবনযাপন করাটা পুঁজিবাদী বাণিজ্যের জন্য বিশেষ অপকারী ।

ঠিক এই কারণেই বাংলাদেশে ইদানিং মিডিয়া বিস্ফোরন ঘটেছে । একের পর এক প্রিন্ট , টিভি মিডিয়া আসছে । জনগণের উন্নতির জন্য আসছে ? নাহ । বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া তথা উপমহাদেশের জীবন দর্শন , যাতে ভোগের বদলে ত্যাগ , উপভোগের বদলে উপলব্ধি আর ইন্দ্রিয় সুখের বদলে ইবাদতের কথা বলা হয়েছে । এই দেড় বিলিওন ক্রেতার মন মানসিকতা চেঞ্জ করে পুঁজিবাদ নামক নতুন ধর্ম শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এই মিডিয়া এসেছে এবং মাল্টিন্যাশনাল গুলা এদের পেছনে এত টাকা ঢালছে । কালচারাল ও পলিটিকাল মূল্যবোধ , ধ্যান ধারনা বদলে মুনাফালোভী করে তোলা , পণ্যের প্রচার ও নতুন ধর্মে ( পুঁজিবাদ) দীক্ষা দেওয়ার জন্য এই এনটারটেইনমেন্ট মিডিয়ার কোন জুড়ি নেই। আমেরিকা , ইউরোপ জয় করে পরীক্ষীত ও সফল অস্ত্র হিসেবে এটি প্রচার হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশে । সুন্দরী প্রতিযোগিতা , ফুয়াদের সেক্সি গান আর লস প্রজেক্ট মার্কা ফারুকী বর্জ্য এই বিপুল " ব্রেইন ওয়াশ " কার্যক্রমের অংশ মাত্র!

অস্থির করার পাশাপাশি ছেলেদের মনের ভিতর কিছু নির্দিষ্ট ইমেজ তৈরী করাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্রেইন ওয়াশ । আমরা বুঝি আর নাই বুঝি , অবচেতন মনে আমরা প্রতিনিয়ত শিখছি , সুন্দর মানে মেহজাবিন। সুন্দর মানে ইষানা। সুন্দর মানে অর্ষা । আমরা যখন সুন্দরকে খুঁজবো , এই রকমই খুঁজবো। পার্থক্য শুধু তারা আমার সামনে ছাড়া আর কারো সামনে কাপড় খুলবে না । ওরাও মডেলই হবে , ভদ্র মডেল ।

এইটা আরো ভয়ংকর। ভয়ংকর এই কারণে যে একটি নির্দিষ্ট মাপ কাঠির বাইরের সবাইকে আমরা " অনাকর্ষনীয় " আখ্যা দিয়ে ফেলছি। আমরা নারী মাত্রেই শরীর বানিয়ে ফেলছি। নারীও মানুষ, অনুভূতি, মগজ সম্পন্ন - সেই বোধ হারিয়ে যাচ্ছে । আমরা বিদূষী বাদ দিয়ে বিদিশা খুঁজছি এখন ক্রমাগত । মানুষ হয়ে যাচ্ছে পদার্থ ।

এই পরিবর্তন , এই ব্রেইন ওয়াশ কতখানি সফল তার একটা উদাহরণ দেই -

প্রথম দিকের কোন পর্বে একটা মেয়ে দুর্দান্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলো , অথচ এই মেয়েদের কোন ট্যালেন্ট পর্ব আমি পাইনি খুঁজে। নিশ্চয়ই অন্য মেয়েরাও এই রকম কিছু না কিছু প্রতিভা নিয়ে এসেছিলো , কিন্তু মাংসের কারবারী ঐদিকে নজর দেয় নাই। যেই মেয়েটা " সবাই ভালো বলেছে তাই আমি কিনেছি" ধরনের প্যাসিভ বক্তব্য দিয়েছিলো , সে বাদ পড়েছে । এইটা একটা ভালো দিক যে একটা মানুষ যার নিজস্ব মতামত বলতে কিছু নাই , তাকে সাথে সাথে বাদ দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট বাজেট ও সময়ে কি করে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হয় , এইটা আমাদের সরকারী প্রোকিউরমেন্টের লোক জনও জানে না । জানাটা জরুরী । কিভাবে ক্লু দেখে রহস্যভেদ করতে হয় , কি ভাবে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয় - এই গুলা খুবই জরুরী গুণ । আমি নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি , ট্রেনিং ক্যাম্পের শিক্ষা গুলা যদি বাদ পড়া মেয়েরা নিজেদের জীবনে ধরে রাখতে পারে ( ভোর পাঁচটায় উঠে শরীর চর্চা আমারে দিয়াও হয় না) তাহলে তাদের উপকারই হবে । সঠিক নিউট্রিশন এবং ফিটনেস মানুষের অনেক বড় সম্পদ । এতগুলা ভালো ভালো দিক চোখে পড়ার পরেও আমি এই প্রতিযোগিতার পক্ষ নিতে পারছি না ।

কেন?

কারণ, সহজাত ভাবেই এই প্রতিযোগিতা যেই কর্পোরেট পুঁজিবাদিতার মন মানসিকতাকে উৎসাহ দেয় , যেভাবে একটা মানুষকে মানুষ থেকে বদলে শরীর সর্বস্ব অব্জেক্ট বানায় , যেভাবে শেখায় তারা ছাড়া বাকি সব অসুন্দর , সুপারস্টার না হলে জীবন ব্যর্থ - এই সব ঘৃণ্য শিক্ষা , মূল্যবোধের অবক্ষয় আর মানুষ না হয়ে ক্রেতা হওয়ার এই ইঁদুর দৌড়কে কোন ভাবেই সমর্থন করা যায় না ।

লাক্স প্রতিযোগিতায় অনেক কিছুই ছিলো , কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে শরীরটাকেই ফোকাসে রাখা হয়েছে , সব সময় ।

সবচাইতে বড় কারন ঃ

কর্পোরেট পুঁজিবাদিতার সব কিছুই ভন্ডামি আর মিথ্যাচারে ভরপুর



কি ভাবে কর্পোরেট পুঁজিবাদ আপনাকে ঘোরের ভিতরে আচ্ছন্ন করে রাখে? তাদের এই শরীর পূজাও এক বিশাল ফাঁকি !


জেনেটিক সাইন্স বলে একটা মানুষ কতটুকু লম্বা , মোটা কিংবা সুন্দর হবে তা নির্ভর করে জেনেটিক্স এর উপর । ক্রিম , সাবান , লতা পাতা ঘষে এইটার খুব একটা পরিবর্তন করা যায় না। ত্বক ফর্সা করার প্রতিটা ক্রিম ভুয়া । স্রেফ মিথ্যা । ত্বকের মেলানিন বেশি হলে আপনি কালো হবেন , মেলানিন কম হলে ফর্সা হবেন । ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমে ভয়াবহ ক্ষতিকারক কেমিকেলস থাকে।

সুন্দর ফিগারের একমাত্র উপায় হইলো খাদ্যাভাস আর শরীর চর্চা। তারপরেও মানুষের শরীর এর মাপ তিন রকম। তবে কাটায় কাটায় তিন আলাদা রকম না । মিক্সড ও আছে । তবে মোটামুটি এপেল , পিয়ার কিংবা দোহারা গড়নই বেশি। মেয়েদের বেলায় যেই আওয়ার গ্লাস ফিগারকে বিশ্ব ব্যাপী আদর্শ বানানো হয়েছে সেই মাপের দেহ পেতে পারবেন কেবল মাত্র ৫% মহিলা । বাকিদের কেউ কেউ সার্জারী করে পারবেন , তারপরেও বেশির ভাগই পাবেন না ।

তার মানে কি দাঁড়াইলো ?

প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ৫ জনের মত হওয়ার জন্য বাকি ৯৫ জন ক্রমাগত ক্রিম ঘষবেন, জিমে যাবেন, ডায়েট করবেন, বিশেষ ধরনের পোশাক পরবেন , কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে সার্জারী করাবেন। কিন্তু কেন?

কারণ , মিডিয়া আপনাকে শেখাবে , তোমার মডেল , তোমার আদর্শ হইলো আওয়ার গ্লাস । এইটা হইলো এমন এক খেলা যাতে মাঠে নামার আগেই আপনি হেরে বসে আছেন কিন্তু আপনাকে প্রতিনিয়তই ব্রেইন ওয়াশ করা হচ্ছে যে , আপনি জিতে যাবেন , আর একটা কিছু কিনলেই!

হু দা হেল আর দে টু টিচ আস হোয়াট ইজ , হু ইস বিউটিফুল? হু ইজ নট?

বাঙালী কয়টা ছেলের সিক্স প্যাক থাকে? সিক্স প্যাক না থাকলেই অন্য কারো গলায় ঝুলে পড়তে হবে? ব্লিঙ ব্লিঙ ডায়মন্ড রিং দিতে না পারলে রাস্তা মাপো ?
আওয়ার গ্লাস না হলে ভালোবাসা যাবে না?

এই প্রশ্ন গুলা আপনি তখন করবেন যখন আপনি একজন মুক্ত চিন্তার, যুক্তিবাদি , স্বাধীন মতের মানুষ হবেন । বিজ্ঞাপনের চটকে বিভ্রান্ত হবেন না । আমরা কয়জন তা পারি?

মানুষের সব চাইতে বড় সৌন্দর্য তার বৈচিত্র । বিচিত্র মানুষ তার বিচিত্র শরীর নিয়ে প্রেম , ভালোবাসা, সেক্স নিয়ে সুখে থাকুক। এইটাই হওয়া উচিত ।

কিন্তু মিডিয়া মোঘলরা , ফ্যাশন এন্ড কসমেটিকদের সাথে হাত মিলিয়ে আমাদের ব্রেইনে সুন্দরের একটা ফিক্সড ইমেজ গেঁথে দিতে বদ্ধ পরিকর । তাও আবার সেইটা শরীর এবং শরীর এর পূজারী।

-----------------------------------------------------

এই ধরনের বিজ্ঞাপন কি আসলেই মানুষকে অন্ধ করতে পারে ?

পারে । গবেষনায় দেখা গেছে একটা সৌন্দর্য পণ্য আদৌ কাজ করে কি করে না তা জানার দরকার নাই । ক্রেতা যদি বিশ্বাস করে যে পণ্যটা কাজ করলেও করতে পারে , তাহলেই চলবে । মানুষের কল্পনা ও সহজাত প্রবৃত্তি এর জন্য দায়ী। খুব ইমেডিয়েট , ক্ষুদ্র সাফল্যকে আমরা বড় করে দেখি । এবং ক্ষুদ্র সাফল্যের উপরে বেস করে বড় বড় রিস্ক নেই । এইটা একটা গেম অফ চান্স ।

লাস ভেগাসে ৯৮% ক্ষেত্রে জুয়াড়িদের জিততে দেওয়া হয় । মাত্র ২% লাভ করা হয় । আর এই মাত্র ২% লাভ দিয়েই মিলিওন মিলিওন ডলারের ব্যবসা চলে । কারন, মানুষ যতক্ষণ বিশ্বাস করবে , " আর একবার খেললেই সে জিতবে " - ততদিন লাস ভেগাসের ব্যবসা সেইফ । আর এক টিউব ফেয়ার এন্ড লাভলী মাখলেই আপনি ফর্সা হবেন ( পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও) , ইউনি লিভারের ব্যবসা সেইফ । স্রেফ হাওয়ার উপরে, মিথ্যার উপরে, ছলনার উপরে সাজানো এই ট্রিলিওন ট্রিলিওন ডলারের প্রসাধন ব্যবসা।

ক্রিম ঘষে আর সার্জারী করেই যদি এনজেলিনা জোলি হওয়া যেত, খোদ হলিউডেই প্রতিদিন ১০টা করে এনজেলিনা পয়দা হইত না?
----------------------------------

শেষের অংশটুকু আসলে লাল সালুর পোস্টে বলা হয়ে গেছে । সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে কামার্ত ব্লগাররা যেই হারে তাদের আদিরসাত্মক ফান করলেন আর দেশের ১০ হাজার " সম্ভাব্য পণ্য বিক্রেতাকে" বেশ্যা বানিয়ে ফেললেন , সেইটা আমার কাছে সেই ১৯৭১ এর ধর্ষকামী ভূতের আছর মনে হয়েছে। একটা মানুষের উপর চড়াও হওয়া তখনই সম্ভব যখন কোন ভাবে সবাইকে কনভিন্স করা সম্ভব যে তারা মানুষ নয় , আমাদের সমান নয়।

The first step towards the most horrific atrocities against human kind is to establish that they are "less than human" , less than what you are .


This happened with black slaves in Africa, this happened with the witch hunt in Europe, this happened with Jews in the holocaust, this happened exactly with 30 lakh people and 2 lakh women in the 1971 genocide in Bangladesh.

Not because they were black.
Not because they were witches.
Not because they were Jews.
Not because they were Bangali.

Because , they were less than human to their oppressors.

পূর্ব পাকিস্তানের মেয়েরা মানুষ নয় । ওরা হিন্দু। ওরা হিন্দুয়ানী ভাষায় কথা বলে। হিন্দুয়ানী পোশাক (শাড়ি) পরে । হিন্দু আচার সংস্কৃতি পালন করে । ওরা মুসল্মান নয় । সুতরাং উহারা মানবেতর ( মানুষের চেয়ে ইতর) প্রাণী ।

অতএব , পূর্ব পাকিস্থানী হিন্দু মেয়েদের খান সেনাদের খাট কাঁপানোর জন্য দিয়ে দেওয়া হউক।
-----------------------
লাক্স সুন্দরীরা বাঙ্গালী নয় । ওরা পশ্চিমা । ওরা বাংলা বলতে পারে না, ওরা খোলামেলা পোশাক পরে , ওরা পশ্চিমা আচার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত । ওরা মুসলমান নয় । সুতরাং উহারা মানবেতর ( মানুষের চেয়ে ইতর ) প্রানী ।

সুতরাং , ইহাদের দিয়ে খাট কাঁপানো হউক।

-----------------------------------


দুইটা গল্পে আমি কোন পার্থক্য পাই না ।

প্রথম গল্পে পাকিস্তানী জোশে জোশিলা রাজাকার ।

দ্বিতীয় গল্পে পাকিস্তানী জোশে জোশিলা বাঙ্গালী ।

সন্দেহ নাই , এই ধরনের প্রতিযোগিতাকে আমি সমর্থন করি না । কিন্তু প্রতিবাদ কিংবা ফানের নামে প্রতিযোগিনীদের সম্ভাব্য বেশ্যা বলে অপমান করাটা কিছুতেই সহ্য করা উচিত না । যেই ১০ হাজার মেয়ে অংশ নিয়েছে তারাও মানুষ । তাদের লাইফ চয়েস নিয়ে আমাদের আপত্তি থাকতে পারে , তার মানে এই না যে আমরা যাচ্ছেতাই ভাবে তাদের হেয় করবো, অবমাননা করবো।
-----------------------------------------------------

সুন্দরী প্রতিযোগিতা কিংবা কর্পোরেট পুঁজিবাদ কেবল নারী নয় , সবাইকেই পণ্য বানায় , ক্রেতা বানায় । হয় তুমি বিক্রি করবে নয় তুমি বিক্রি হবে । কারন এই মতবাদের মূলে আছে শুধুই লাভ , কেবল সাপ্লাই আর ডিমান্ড ।

কিন্তু মানুষের সবচেয়ে বড় যেই ডিমান্ড ,
ভালোবাসা । আধ্যাত্মিক বা স্পিরিচুয়াল নিড । মূল্য পাওয়া বা মূল্য দেওয়া । সম্মান ও সাফল্যের ভিতরে প্রচ্যের যেই দর্শন রয়েছে , সেই দর্শনকে পুঁজিবাদ ধ্বংস করতে চায় ।

আমরা যে বিশ্বাস করি , এই জীবনটাই সব নয় , এইখানে সব কিছু পাওয়ার নেশায় আশে পাশের সবাইকে, ন্যায় - নীতি - মূল্যবোধকে পায়ে দলে যাবার দরকার নেই ! সব কিছু খুবলে খাওয়া নয় , যা আছে - সেই সামান্যটুকুই সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়ার ভেতরে আনন্দ অনেক বেশি - এই সব পুঁজিবাদ বুঝে না ।

পুঁজিবাদ হলো সেই আগুন যা খেতে খেতে বড় হয় । যারা উচ্ছিষ্টটুকু পায়, তারা এর নানান গুণাগুণ বর্ননা করে । ইনোভেশন , ক্রিয়েটিভিটি, ডিস্কভারি , ব্লাহ ব্লাহ ।

কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে , কিসের মূল্যে ? এট দা কস্ট অফ হোয়াট?
------------------------------------------

আজকের যুগে আপনার বউ এর পেটে যেই ভ্রুণটা আছে সেইটাকে বের করে একজন ক্যান্সার রোগী , একজন হার্টের রোগী কিংবা একজন কিডনীর রোগীকে বাঁচানো সম্ভব।

এখন এই টেকনোলজিটাকে যদি কর্পোরেট পুঁজিবাদের সাথে তুলনা করি তাহলে , আপনি এই ধরনের পুঁজিবাদ ও অর্থনীতিকে সমর্থন করবেন কিনা তা নির্ভর করবে আপনি কি সেই
১। মা?
২। ভ্রুণ ?
৩। সার্জন ?
নাকি ,
৪। মৃত্যু পথযাত্রী রোগী?


লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার কারো কারো জন্য কিছু কিছু উপকার বয়ে আনবে এইটা সত্য। কিন্তু , প্রশ্ন সেই একটাই , কিসের বিনিময়ে? কতখানি মূল্যে?

http://www.somewhereinblog.net/blog/valobashablog/29085855


বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে উচ্চশিক্ষা, বৃত্তি/স্কলারশীপ এবং (এপ্লিকেশন পর্ব)

আগেই বলেছি , এখন অনলাইনে এপ্লিকেশন করা কোন ব্যাপারই না । মূল কাজটা ওয়েবে বসেই করে ফেলা যায়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পিডিএফ নিয়েই খুশি থাকে । সশরীরে যেদিন গিয়ে উপস্থিত হবেন তার আগে কিছু নাও লাগতে পারে এক টাকা পয়সার ব্যাপার স্যাপার ছাড়া । অনেক জায়গায় হয়ত সফট কপির সাথে হার্ড কপিও পাঠাতে হতে পারে মেইল করে । যেই সব ইউনিতে অন লাইন এপ্লিকেশনের ব্যবস্থা নেই তাদেরকে রেজিস্টার্ড মেইলে , যে সবে অনলাইন ট্র্যাকিং করা যায় এই রকম ভাবে পাঠিয়ে দিন। কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠানো নিরাপদ কিন্তু বুহতেই পারছেন এক একবারে কত টাকা করে লাগতে পারে।

এপ্লিকেশন পাঠানোর আগে দেখে নিন সমস্ত কাগজ পত্র ঠিক আছে কিনা।
১। একাডেমিক কাগজ পত্র , মোটিভেশন লেটার ইত্যাদি আপনি নিজেই পাঠাবেন।

২। ইউনি যদি চায় , তাহলে আই ই এল টি এস বা টয়েফেল ইত্যাদির রেজাল্ট হয়ত অফিসিয়ালি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠাতে বলবে । সেক্ষেত্রে আপনি একটা নির্দিষ্ট ফি দিয়ে কোম্পানিকে অনুরোধ করলে ওরাই আপনার রেজাল্ট ইউনিকে পাঠিয়ে দেবে।

৩। রেকমেন্ডেশন লেটার সংশ্লিষ্ট প্রফেসর অফিসিয়াল খামে, অফিসিয়াল সিল সহ পাঠাবেন। আপনি শুধু তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। আর কিছু না । আমেরিকাতে এইসব নিয়ে বেগড়বাই বেশি করে । তো সাবধান। যদি ওদের মনে হয় আপনি নিজে এই রেকমেন্ডেশনকে কোন ভাবে প্রভাবিত করেছেন, তাইলেই সব শেষ ।

৪। ট্রান্সক্রিপ্ট পাঠাবে আপনার কলেজ/মেডিকেল/ইউনি। কিন্তু আমাদের দেশে সব জায়গায় এইটা করা যায় না । আবার ট্রান্সক্রিপ্ট জিনিসটা আপনি যতবার অনুরোধ করবেন ততবারই আপনার হয়ে আপনার কলেজ।ইউনির দেওয়ার কথা । কি এক অদ্ভুত কারনে , এইটা সবাই বার বার দেয় না । স্কুল কলেজের ট্রান্সক্রিপ্ট তো সোনার হরিণ ।

সুতরাং , চাইলেই লাফ দিয়ে মূল কপিটা পাঠিয়ে দেবেন না । একটাই কপি হলে ফটোকপি পাঠান এবং বুঝিয়ে বলুন কেন মূল কপি পাঠাতে পারছেন না কিংবা আপনার হয়ে কলেজ কেন পাঠাচ্ছে না । ভদ্র ভাবে বুঝিয়ে বললে আর সৎ হলে বেশির ভাগ ইউনিই ঝামেলা করে না ।

৫। সব কাগজ এক সাথে পাঠানোর জন্য দেরী করবেন না । যেমন আই ঈ এল টি এসের রেজাল্ট পরে পাঠালেও চলে। কিন্তু এপ্লিকেশন দেরীতে পৌছালে স্কলারশীপ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে ।

এখন আসেন , কখন পাঠাবেন?

আমেরিকা , কানাডা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ বেশি গবেষনা করে , তাই আর ডিটেইলস এ গেলাম না । যে কোন ভালো স্কলারশীপ পেতে হলে অন্তত এক বছর আছে কাগজ পত্র পাঠাতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় , লাস্ট ডেট অনেক পরে শেষ হয়। কিন্তু খেয়াল না করলে এইটা হয়ত আপনার চোখেই পড়বে না যে ভর্তির লাস্ট ডেটের ৬ মাস আগেই স্কলারশীপের লাস্ট ডেট শেষ। আবার আমেরিকার এক এক স্টেটে এক এক নিয়মের কারনে কোন সাধারন নিয়ম বলা খুবই মুশকিল। কোথাও নিয়ম কানুন খুব কড়া , কোথাও বেশ শিথিল। সুতরাং, বছর খানেক আগে থেকেই দেখে নিন কোন স্কলারশীপের ডেট সাধারনত কখন শেষ হয় ।

মিড ইয়ার সেমিস্টারে ভর্তি হলে বা পার্ট টাইম ( বিদেশী স্টুডেন্ট অবশ্য প্রায় সবই ফুল টাইম) হলে অনেক স্কলারশীপ দেয় না । অতএব সাধু সাবধান।

অস্ট্রেলিয়া , নিউজিল্যান্ডে সেমিস্টার শুরু সাধারনত ফেব্রুয়ারী মার্চের দিকে । ইউরোপে সেপ্টেম্বর । কিন্তু দেখা যায় , ক্লাস সেপ্টেম্বর হলেও ভালো ভালো স্কলারশীপ গুলোর ডেট ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারীর ভিতরই শেষ। তার উপর অনেক জায়গায় লেখা থাকে আগে আসিলে আগে পাইবেন, আগে বিবেচিত হইবেন ধরনের কথা । তাই যত আগে এপ্লাই করা যায় , স্কলারশীপ পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি ।

স্কলারশীপের আবেদন কে করবে ?

এই জায়গাটাতেও অনেক রকমের হ্যাপা জড়িত। কোন কোন স্কলারশীপ এর আবেদন আপনাকে নিজেই করতে হতে পারে । এক একটার এলিজিবিলিটি এক এক রকম । কেউ হয়ত চায় আপনার এডমিশন কনফার্মেশন। কেউ চাইবে যেখানে ভর্তি হবেন তাদের রেকমেন্ডেশন, সেক্ষেত্রে ডিপার্টমেন্ট যা করার করবে , আপনি শুধু উল্লেখ করবেন যে আপনি বিবেচিত হইতে চান । আবার অনেক ইউনি বলেই দেবে যে সকল বিদেশী ছাত্র অটমেটিক বিবেচিত হয় সুতরাং আলাদা করে এপ্লাই করার দরকার নেই ।

যেহেতু এক এক জায়গায় এক এক নিয়ম , তাই আগে থেকে ভর্তি বা এপ্লাই করার ফর্মালিটি সেরে নিয়ে লেগে পড়ুন কাজে ।

আপনি কখন বিবেচিত হবেন?

আমেরিকা , অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের ভিতর গ্রেট ব্রিটেন এবং এশিয়ার বেশ কয়টি দেশ একটা নিয়ম মেনে চলে । তা হলো , আগে ভর্তি তারপর স্কলারশীপ। তার মানে ভর্তি হতে , ভিসা পেতে এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রথম এক বছর বা প্রথম এক সেমিস্টারের টাকার যোগাড় আপনাকে করে রাখতে হবে । এই সব কিছু খরচ পাতি করে , রেজাল্ট ভালো দেখায় ২য় সেমিস্টার বা ২য় বছরে আপনি প্রচুর স্কলারশীপ পাবেন অস্ট্রেলিয়াতে ।

তবে, লিডারশীপ, কমন ওয়েলথ, এডিবি, এন এফ পি জাতীয় স্কলারশীপ গুলো দেশ থেকে নিয়েই বাইরে যাওয়া যায় ।

ডাক্তারী যে কোন বিদ্যায় এই প্রাথমিক খরচটা অসম্ভব রকমের বেশি। তবে বায়ো লজি, বায়ো ফিজিক্স, বায়ো কেমিস্ট্রি, বায়ো টেকনোলজি, মেডিকেল বায়োলজি , মলিকিউলার বায়োলজি জাতীয় নন ক্লিনিকাল কোন সাব্জেক্টের ভর্তি খরচ এত না। এই সব দেশে যেতে হলে তাই আগে পকেটের অবস্থা আর স্কলারশীপ ছাড়াই প্রথম এক বছর সামলাইতে পারবেন কিনা বুঝে নিন।

স্টুডেন্টদের কাজ করার অনুমতি আছে কিনা , থাকলেও কয় ঘন্টা, কাজের সহজলভ্যতা ইত্যাদি আগেই হিসাব করে নিবেন।

ইউরোপে ওরা স্কলারশীপ ভর্তির সাথে সাথে জানিয়ে দেয়। সেই কাগজ নিয়ে ভিসা পাওয়াও সম্ভব । তাই অনেক নিরাপদ । বিদেশে গিয়ে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা অনেক কম যেহেতু আগে থেকেই জেনে যাচ্ছেন কত পাচ্ছেন, কত খরচ হবে আর নিজে পকেটে করে কত নিয়ে যেতে হবে। মাস্টার্স লেভেলে কাজ করার অনুমতি আছে এবং সেইটা দিয়ে কোন মতে থাকা খাওয়া চলে যায় । কিন্তু খবরদার সেলফ ফাইন্যন্সে যাওয়ার চিন্তা করবেন না এবং এইটা মনে রাখবেন , বেশির ভাগ ইউরোপে কেউ ইংরেজি বলে না , তাই কাজ পাওয়া খুবই কঠিন । অবশ্যই আগে ভাষা শিখতে হয়। কিছু দেশে প্রথম একটা বছর নষ্ট করতে হয় স্রেফ ভাষা শিখে । তারপর আসল পড়ালেখা শুরু। ইংলিশ মাস্টার্স হইলে অন্য কথা ।

স্কলারশীপের পরিমাণ কত ?

এডিবি, লিডারশীপ, কমন ওয়েলথ, ফোর্ড, রোটারি , এন এফ পি আরো হাবিজাবি স্কলারশীপ আছে । এগুলো সব ফুল স্কলারশীপ। টিউশন , থাকা , খাওয়া , মায় প্লেনের টিকেট পর্যন্ত দিয়ে দেবে। কিন্তুক , ঝামেলাটা হইলো, এই ধরনের যত স্কলারশীপ আছে , সব গুলাই কোর্স শেষ হওয়ার সাথে সাথে কানে ধরে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। এবং তারপরের দুই বছর সেই দেশে ঢুকা যাবে না , নিজের দেশে কাজ করতে হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারী কর্মকর্তা হইতে হবে, আবার অন্য আর কোন স্কলারশীপের জন্য বিবেচিত হবেন না ধরনের নানা রকম শর্ত জুড়ে দেওয়া থাকে। তাই আগেই খুব ভালো করে ভেবে নিন, আপনি কি দেশে ফেরত আসবেন?

তাহলে এই ধরনের স্কলারশীপের জন্য আবেদন করুন। আগে থেকে চেষ্টা করলে, লেগে থাকলে আর সরকারী জ্যাক থাকলে পেয়ে যাবেন। এসবে রেজাল্ট খুবই ভালো থাকতে হয়। টপ ১০% বা ৮০% মার্ক্স চায় ইত্যাদি ইত্যাদি । খুব ভালো করে প্রতিটা ইংরেজি বাংলা দৈনিকের চিপায় চাপায় চোখ দিয়ে রাখবেন । আর মাঝে মাঝেই এম্ব্যাসির খাটাস্মুখী বা মুখিনীদের হাই হ্যালো করে জিজ্ঞেস করবেন বা ঢাকাস্থ এম্ব্যসির ওয়েব হুতাগুতি করবেন , কখন এড দেয় । বৃটিশ কাউন্সিল , ইউসিস , আব জাব সব খানে চর লাগায় রাখবেন ।

কিন্তু এই সব কুতুব আর কয়জন? বাকি বটম ৯০% এর জন্য খোজাখুজিই ভরসা ।

সাধারন ইউনি স্কলারশীপ গুলা ভ্যরি করে । যাদের ফান্ড বেশি , নাম বেশি তারা পয়সা দেয় বেশি । যাদের ফান্ড কম , তারা টিউশন মাফ করে দেয় , থাকা খাওয়া আপনের ।

তবে , সবচাইতে বেহুদা বান্দর হইলো আমেরিকা , অজি আর বেনিয়া বৃটিশ । কারনটা আগেই বলেছি । নিজে কিছু গচ্চা দেওয়ার পরেই কিছু পাইবেন । তার আগে না । ইউ কের বায়োলজি স্কলারশীপের অবস্থা বড়ই করুন । সর্বোচ্চ ৮০%। বাকিটা দিতে জান কাহিল । এইটা পাবলিক হেলথ জাতীয় সাব্জেক্টের বেলাতেও সত্যি । আমেরিকা আবার যখন দেয় তখন ভালো করেই দেয় । তো আপনি যদি ভর্তি ও ভিসা সংক্রান্ত টাকা পয়সার ঝামেলা কাটাইতে পারেন তাইলে তো আর চিন্তা নাই ।

তবে আগেই বলেছি , আমেরিকা হইলো সব সম্ভবের দেশ । অনেক ইউনি আছে যেখানে ভর্তি কনফার্ম হয়ে যাওয়ার পরে অনেক স্কলারশীপের সম্ভাবনা খুলে যায় । দেশে ছাড়ার আগেই সেখানে স্কলারশীপ কনফার্ম করতেই পারেন ।

কোন সাবজ়েক্ট , কেন ?

কান ধরে যদি দেশে পাঠিয়ে দেয় তাহলে স্কলারশীপ কমিটি দেখবে কোন সাবজেক্ট আপনার নিজের দেশের জন্য প্রযোজ্য। আর তা না করলে অবশ্যই দেখবে কোন সাব্জেক্ট এর লোক ওদের নিজেদের লাগবে । সারা দুনিয়ায় ডাক্তাররা হইলো এতিম জাত । মেডিকেল কিংবা ডেন্টালের কোন বিদ্যাতেই কোন রকম স্কলারশীপ নাই । একমাত্র বিশ্ববিখ্যাত নামী দামী স্কলারশীপ ছাড়া মেডিকেল , ডেন্টালের সাব্জেক্ট পড়া যায় না । তাও আবার নন ক্লিনিকাল সাব্জেক্ট হইতে হয় । ক্লিনিকাল সাব্জেক্টে বিদেশে পড়তে চাইলে সেইটার লাইন ঘাট একেবারেই ভিন্ন । সরকারী কর্মকর্তা হইলে , ঐ সব বিশ্ববিখ্যাত স্কলারশীপ পাইলে , দেশে ফেরত আসিবার শর্তে রাজি থাকিলে তখন এই সব ভাবা যাইতে পারে । নাইলে ডাক্তার হইয়া বাইরে স্কলারশীপ খুজিবার কোনই মানে নাই । বাপ মা কোটিপতি হইলে ভিন্ন কথা ।

যারা ক্লিনিকাল সাব্জেক্ট ছেড়ে পাবলিক হেলথ, এনাটমি, ফিজিওলজি কিংবা এপ্লাইড বায়োলজিকাল সাইন্সেস পড়তে আগ্রহী তারা সময় থাকতে থাকতে এপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিন। সাব্জেক্ট বেছে নেওয়ার সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা আমেরিকা ও কানাডায় । অনেক রকমের কম্বিনেশন নেওয়া যায় । তাছাড়া সাব্জেক্টের বৈচিত্রও ওদের অনেক বেশি । যারা নন ডাক্তার বায়োলজির কোন সাব্জেক্ট পড়েছেন , তাদের জন্য আমেরিকা এখনো স্বর্গ । প্রচুর স্কলারশীপ, প্রচুর গবেষনা , কাজেরও সম্ভাবনা ।

দেশে ফিরতে না চাইলে ডাক্তার আর ডেন্টিস্টদের স্বর্গ এখন অস্ট্রেলিয়া । একটা যে কোন সাব্জেক্ট নিয়ে ঢুকে পড়ার পরে লাইসেন্স পরীক্ষা পাশ করুন। ২ -৩ বছরে মাইগ্রেন্ট হয়ে যান । তারপর খালি টাকা আর টাকা । এমন কি পড়াও লাগবে না । দেশ থেকেই মাইগ্রেন্ট হয়ে চলে যান ওদের ডাক্তার কম এমন কোন রিজিওনে। চুক্তি করুন দুই বছরের । ব্যাস । আর দেখতে হবে না । সাব্জেক্টের মধ্যে মেডিকেল বায়োলজি থেকে শুরু করে বায়োটেকনলজি সবই আছে । কিন্তু ওরা স্কলারশীপ দেয় শুধু নিজের দেশের লোকজনকেই । মাইগ্রেন্ট বা সিটিজেন না হলে মাসে ১০০ , ২০০ ডলার পাবেন । তবে , মেয়েদের জন্য বেশ কিছু ভালো ভালো স্কলারশীপ আছে ।

ইউরোপে বায়োলজিকাল সাইন্সের বিভিন্ন ব্রাঞ্চে এখন প্রায় রেভেলুশন চলছে । আমেরিকার যেমন স্টেম সেল, জেনেটিক্স নিয়ে নানান রকম ধর্মীয় হ্যাপা আছে , ইউরোপে সেটা বেশ কম। তাই নরমাল বায়োলজিকাল সাব্জেক্ট ছাড়াও অনেক চ্যালেঞ্জিং নতুন নতুন মাস্টার কোর্স পাওয়া যায় , স্কলারশীপের পরিমান ও ভালো । ভাষা জনিত সমস্যাটা কাটিয়ে উঠতে পারলে কেল্লাফতে । পি এইচ ডি পাওয়াও কঠিন না ।

ইউরোপের আরো একটা জিনিস ভালো লেগেছে । পি এইচ ডি জিনিসটা নাকি ইউরোপে জবের মত । স্টুডেন্ট না এম্পলয়ি হিসেবে পি এইচ ডি করা যায় । বেতন ও খারাপ না ।মাস্টার্সের পরে পি এইচ ডি করতে চাইলে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার সাথে এইটা তুলনা করা যাইতে পারে ।

বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে উচ্চশিক্ষা, বৃত্তি/স্কলারশীপ এবং (প্রস্তুতি পর্ব)

প্রথমেই বলে নেই , এই পোস্ট কোন গবেষনা নয়, স্রেফ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে লেখা । নিজের কাজে খোঁজ করতে গিয়ে যা দেখেছি তাই লিখে দিলাম। দ্বিতীয়ত , এই লেখায় শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষার জন্য, তার মানে ব্যাচেলর নয়, তদুর্ধ্ব শ্রেনীর বৃত্তি নিয়ে লেখা । তৃতীয়ত , এখানে আমেরিকা বলতে উত্তর আমেরিকার দেশ মূলত আমেরিকা এবং কানাডা , অস্ট্রেলিয়া বলতে নিউজিল্যান্ডসহ এবং ইউরোপ বলতে ইউরোপের ধনী ও পরিচিত যে দেশগুলোয় বাংলাদেশ থেকে মানুষ পড়তে যায়, তাদের কথাই বলা হয়েছে । পড়ার সময় সেইভাবে ধরে নেবেন। আর শেষ কথা হলো, আপনার পড়ালেখাতে যদি বায়োলজি বিষয়টা না থাকে তো এই সব স্কলারশীপ আপনার জন্য নয়, আপনার ভাই বোন বন্ধুর কাজে লাগতে পারে । তবে , প্রস্তুতি পর্বটা সবার জন্যই কমন।

শুরু বা পরিকল্পনা পর্যায় ঃ

১। সময় ঃ আপনার ব্যক্তিগত পরিস্থিতি যাই হোক না কেন , আপনি যেই মহাদেশেই যান না কেন , কিছুটা যোগ বিয়োগ করে সব কিছু ঠিক ঠাক করে নিতে প্রায় ১২ মাস লাগবেই বিশেষ করে স্কলারশিপ ও টাকা পয়সা যোগাড় ইত্যাদি। সুতরাং যখনই শুরু করুন না কেন, আগে জেনে নিন আপনি যেখানে যেতে চাইছেন , সেখানে কোন মাসে ক্লাস শুরু হয়? সেই মতে আপনার হাতে কতটুকু সময় আছে বুঝে নিন। একটা সাধারন নিয়ম হলো যেই বছর যেতে চাই তার আগের বছর থেকে কাজ শুরু করা।
২।তথ্য সংগ্রহঃ এরপর সময় নিয়ে যেই দেশে যাবেন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ওয়েবসাইট খুটিয়ে খুটিয়ে পড়া। এর কোনই বিকল্প নাই, প্রচুর দিন, প্রচুর রাত নষ্ট হবে এই কাজটার পিছনে। কিন্তু, দিন রাত ২৪ ঘন্টা যদি লেগে থাকতে পারেন , তাহলে তার ফলও পাবেন হাতে নাতে । এমন কোন তথ্য পেয়ে যেতে পারেন যেটা হয়ত আপনার সময় , তারচেয়েও বড় কথা টাকা বাচিয়ে দেবে অনেক। সব সময়ই ওয়েব সাইটের বাইরে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এমন কারো কাছ থেকে কেমনে কি জেনে নিন যদি সেই সুযোগ থাকে।
৩। তথ্য সাজানোঃ নির্দিষ্ট কোন বিশ্ববিদ্যালয় এর কোন কোর্স পছন্দ হলে সাথে সাথে সেই কোর্সের সমস্ত তথ্য সারাংশ , বিভিন্ন লিঙ্ক আপনার খাতা/ফাইল/কম্পিউটারে টুকে নিন। ওহ আচ্ছা, বলে রাখি, সাজিয়ে গুছিয়ে কাজ করলে সবচেয়ে ভালো। খাতা বই এর যুগ যেহেতু শেষ , কম্পিউটারে ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশের ফোল্ডার, তার ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোল্ডার করে তাতে কিভাবে তথ্য সাজাবেন, কি করে সে গুলো দ্রুত খুঁজে পাবেন সেভাবে পরিকল্পনা করে নিন।
কিছু ফাইল সব খানেই থাকবে যেমন,
ক) একটা ফাইলে সব কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন তারিখ ( এপ্লিকেশন, স্কলারশীপ, রেস্পন্স, সেমিস্টার ডেট ইত্যাদি) , পুরোটা পড়েছেন কিনা, কাগজ পত্র পাঠানো হয়েছে কি হয়নি ধরনের ম্যাট্রিক্সসহ একটা ইন্ডেক্স পেজ।
খ) আরেকটা ফাইল থাকবে ঐ মহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সাধারনত কোন কাগজ গুলো কি ভাবে চায় তার লিস্ট । একেক জায়গায় একেক ভাবে চাইতে পারে । কমন বাদ দিয়ে যেইটা ব্যতিক্রম সেইটা লাল কালিতে উল্লেখ করে রাখলেই ভালো ।
৪। কাগজ পত্র তৈরীঃ একাডেমিক সমস্ত কাগজ এর মূল এবং দরকার হলে ইংরেজী কপি (এটাও মূল) তৈরী রাখুন। বিভিন্ন সার্টিফিকেট বলতে আমরা যা বুঝি ( এস এস সি, এইচ এস সি , মেডিকেল/ডেন্টাল/ইউনি , ডাক্তারদের বি এম ডি সি রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি) তার বাইরে কিছু কাগজ নিয়ে মহা ঝামেলা লাগে । যেমন,

ক)ট্রান্সক্রিপ্ট- এইখানে আপনার বিশ্ববিদ্যালয় একটা কাগজেই আপনি কি কি বিষয় পড়েছেন, সেই সবের মেজর মাইনর, কত অংশ তাত্ত্বিক আর কত অংশ প্র্যাক্টিকাল বা ল্যাব/ ক্লিনিকাল করেছেন তার ঘন্টা ও বিষয়সহ উল্লেখ, আপনার সমস্ত গ্রেড/রেজাল্ট , আপনি সার্বিক বিচারে আপনার ক্লাসের টপ ১০% এ পড়েন কিনা জাতীয় তথ্যসহ এক নজরে একটা ছক আকারে দিয়ে দেবে। দুঃখের কথা হলো, এই ট্রান্সক্রিপ্ট জিনিসটা খায় না মাথায় দেয় সেইটা অনেক সরকারী ও বনেদী মেডিকেল কলেজ কিংবা বায়োলজি শিখানেওয়ালা বিশ্ববিদ্যালয় জানবেই না । জানলেও যা দেবে সেইটা আপনার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা চেয়েছে তার ধারে কাছে নাও থাকতে পারে। এত ডিটেইলস বেশির ভাগ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়/মেডিকেল/ডেন্টাল দেয় না।
ঠেকায় পড়লে নিজেই বানিয়ে নিন। তারপর অফিসিয়াল প্যাডে প্রিন্ট করে অফিস থেকে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন ছিল ছাপ্পর, সাক্ষরসহ। খেয়াল রাখবেন, ওরা খোঁজ করলে এইদিকে কেউ যেন রেফারেন্স হিসেবে সত্যতা প্রমান দিতে পারে । কথা হলো, আপনার কাগজ আপনার বানানো হইলে সমস্যা নাই যতক্ষন পর্যন্ত আপনার সব কিছু অফিসিয়াল প্যাডে থাকে আর সংশ্লিষ্ট লোক জন জানে এই রকম একটা কিছু কোথাও পাঠানো হয়েছে । বলা যায় না, আল্লাহ করে তো আপনারটা দেখেই হয়ত ওরা নিজেদেরটা বদলে নেবে। আপনার ট্রান্সক্রিপ্ট যদি আপনাকেই বানাইতে হয় তাহলে সেইটার কয়েক কপি মেডিকেলের/ইউনির অফিসে দিয়ে রাখবেন।

খ) মোটিভেশন লেটার- আপনি কেন পড়তে চান, পড়িলে কি করিবেন, পাশ দিয়া আল্লাহর দুনিয়াতে কি কি বিপ্লব করিবার ইচ্ছা রাখেন সহ আরো অনেক কিছু উল্লেখ করে এই লেটার লিখতে হতে পারে । সুতরাং, আগে দেখে নিন যাকে পাঠাবেন সে কোন ফর্ম আগেই দিয়ে রেখেছে কিনা। অনেক সময় ফর্ম না থাকলেও আগের বছরের সাকসেস্ফুল কুতুবেরা কি লিখিয়াছিলেন তা দেওয়া থাকে। ঐ সব পড়ে জ্ঞানী হইয়া তারপর লিখেন। নিশ্চিত থাকেন যে এই লেটার আপনার গন্ডায় গন্ডায় পারমুটেশন কম্বিনেশন করে শ’খানেক লিখতেই হবে। এক একটা এক এক জায়গার ইউনির জন্য।
গ) আগের গবেষনা কিংবা কাজের অভিজ্ঞতার বর্ননা ( যদি প্রযোজ্য হয়) – এইটার সারাংশ থেকে শুরু করে কাকে কবে চোখ মেরেছিলেন জাতীয় ডিটেইলসসহ চাহ্নেওয়ালা লোকও এই দুনিয়ায় আছে। সুতরাং, যেখানে যা চায় যেভাবে চায় খেয়াল করে এইটার বর্ননা লিখুন এবং নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোল্ডারে সেভ করুন।কি নিয়ে গবেষনা করেছিলেন, কারো ফান্ড জিতেছিলেন কিনা, ডিজাইন থেকে কন্ডাক্ট ও রিপোর্ট রাইটিং পুরোটাই আপনার নিজের কুকাম কিনা এই সব উল্লেখ করতে হইতে পারে।
ঘ) রেকমেন্ডেশন লেটার- অনেক জায়গায় সাধারন কাগজে প্রিন্ট করে প্রফেসর , বস ইত্যাদির সাইন নিয়ে নিজে পাঠালেই চলে। তবে আজকাল বেশির ভাগ ইউনি নির্দিষ্ট ফর্ম দিয়ে দেয়। ওয়েব সাইট থেকে প্রিন্ট করে সেইটা যেই প্রফেসর কিংবা বস রেকমেন্ড করবেন তিনি নিজে পূরণ করবেন, সম্পূর্ন গোপনীয়তা রক্ষা করে সিল গালা মেরে তিনিই পাঠাবেন। মানে আপনার নিজের সেইখানে কিছু করার নাই। তবে, ইউনি তো আর এসে দেখে যাচ্ছে না। সুতরাং, ব্যস্ত প্রফেসরের পিছনে না ঘুরে যা করার করে নেন, তারপর তাকে ভালো করে দেখিয়ে সাইন করে অবশ্যই অবশ্যই অফিসিয়ালি , মানে অফিসের খামে , সিল সহ পাঠান।এই কান্ঠামিটা করতে বলতে খারাপ লাগছে কিন্তু ভুক্তভোগী হিসেবে জানি রেকমেন্ডেশনের মত একটা অতি জরুরী কাজ অনেক প্রফেসর হয় বোঝেনা, নয় করতে চায় না। এইসব ব্যাপারে লাক আর ব্যক্তির উপর নির্ভর করে সময়মত ভালো জিনিস পাবেন কিনা।

ঙ) ইংরেজী কিংবা মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষার লেভেল – আগে দেখে নিন ভাষার ব্যাপারে ওরা কি চাচ্ছে। টোফেল, জি আর ই, আই ই এল টি এস ইত্যাদির গ্রেডিং এর পদ্ধতি ওদের নিজের । ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষার ব্যাপারে অফিসিয়াল সার্টিফিকেট (কোন অথরিটি থেকে পরীক্ষা দিয়ে পাওয়া) না থাকলে রিডিং, রাইটিং, স্পোকেন, লিসেনিং এই ভাবে ভাগ করে নিজেই গ্রেড দেওয়া লাগতে পারে । সেক্ষেত্রে দেখে নিন গ্রেডিং এর বর্ননা বা স্ট্যান্ডার্ড কোথাও ব্যাখ্যা করা আছে কিনা। আপনার নিজের লেভেল কোন গ্রেডের সাথে মেলে। গুগুল করলেই পাবেন।যেমন- বাংলা ইংরেজির বাইরে আমি হিন্দী কেবল বলতেই জানি, লিখতে পড়তে পারি না ইত্যাদি। বায়োলজির জন্য আলাদা জি আর ই আছে। বাংলাদেশ থেকে দেওয়া যায় কিনা জানি না। না গেলে জেনারেলটাই সই। উল্লেখ্য, জি আর ই পড়তে কয়েক মাস থেকে বছর খানেক সময় লেগে যেতে পারে । সুতরাং যেই মহান ভোরে বাইরে পড়তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিবেন, সেই দিন থেকেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়তে শুরু করে দিন।

চ) এর বাইরে কিছু কাগজ লাগলেও লাগতে পারে । সাধারনত লাগে না । যেমন- বার্থ সার্টিফিকেট যদি যেখানে জন্মাইছিলেন সেইখানে যাওয়া লাগে তো বিরাট ক্যাচাল। সিটিজেনশীপ (নাগরিকত্ব) এর সার্টিফিকেট লাগে না, লাগার কথা না কারন আপনার পাসপোর্ট প্রমান করে আপনি বাংলাদেশের নাগরিক। ম্যারেজ সার্টিফিকেট হইলো সবচেয়ে ঝামেলার।কাজীর অফিস থেকেই রেজিষ্ট্রির জন্য পাঠিয়ে দেবে। দায়িত্ব নিয়ে উঠানোর দায় আপনার। তারপর অবশ্যই ফরেন মিনিষ্ট্রি থেকে সত্যায়িত করে নিবেন। আল্লাহর রহমতে পরিচিত কেউ না থাকলে এইটা করতে বছর কাবার না হয়ে যায়, এইটা মনে রাইখেন। যারা শহীদ হইয়া বাইরে যাইতে চান ও বউ/স্বামী সাথে লইবেন ভাবেন, তারা বিবাহের পরে হানিমুন বাদ দিয়া আগে এই কাজটা করবেন। অনেকে দেখি পুলিশ ভেরিফিকেশন, এন ও সি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। এই সব লাগে ভাই মাইগ্রেশন করতে। পড়তে যাওয়ার জন্য এই সব লাগে না।

ছ) কাগজ পত্তর সব রেডি হয়ে গেলে সব কয়টার স্ক্যান করে পি ডি এফ বানায় সেভ করে রাখেন। আখেরে অনেক কাজে দিবে।

জ) যেই সব এক্সট্রা কারিকুলার কাজ, কর্ম, শখরে আমাগো আব্বা আম্মা কিংবা চাচা -মামারা পাত্তাই দেয় না , সেই সবের দাম বাইরে অনেক বেশি। বুকিশ পাব্লিক কেউ চায় না, পছন্দও করে না। স্কলারশীপ পাইতে হইলে যা যা করেন, করেছেন সেইটার একটা কাগুজে বা প্রমান করা যায় ডকুমেন্ট রাখতে পারলে ভালো। খেলা ধুলা, গান বাজনা , প্রতিযোগিতা তো আছেই, আপনি যদি ভলান্টিয়ার, অর্গানাইজার হোন তাইলে ছবি তুলেন, পত্রিকায় প্রকাশ হইলে কাইটা রাখেন, অন লাইন ম্যাগাজিন হইলে লিঙ্ক সেভ করেন, স্কুল কলেজের ওয়েব সাইট বা বই পত্তরে ছাপায়ে রাখেন। কখন যে কোনটা কাজে লাগবে, কিছুই বলা যায় না। টেরিফক্স রান, নিখিল বাংলাদেশ কুত্তা রক্ষা কমিটি, গাছপ্রেমী যাই হোন না কেন, আপনার সদস্যপদ সি ভিতে উল্লেখ কইরেন। তবে, আগে বুইঝা নিবেন কে কি চায়, আর কে কি একেবারেই চায় না।

সবার শেষে সবচেয়ে জরুরী জিনিস এপ্লিকেশন। ফর্ম সব কয়টা ইউনির ওয়েব সাইটেই পাবেন। আজকের দুনিয়াতে অন লাইন এপ্লিকেশন করা ডাল ভাত। অনেক ইউনিতেই এই ব্যবস্থা আছে। আবার অনেক ইউনি কমন একটা ওয়েব এপ্লিকেশন নেয়, আলাদা আলাদা করে করার দরকার হয় না। পূরণ করলে আপনাকে নাম্বার দেবে একটা পাসোয়ার্ড , একাউন্ট ইত্যাদি সহ। দরকার হইলে পরে ঢুকে আরো তথ্য যোগ করতে পারবেন। অনেক জায়গায় একাডেমিক কাগজ পত্র পি ডি এফ চায়। সেইগুলা আপ্লোডাইতে পারবেন। পাশাপাশি হার্ড কপি মেইল করে দিতে হবে। অবশ্যই রেজিস্ট্রি মেইল করবেন, অন লাইন ট্রাকিং করা যায় এমন জায়গা থেকে মেইল করবেন। এই সব মেইল হারানো গেলে জীবনটাই বিলা!

ভাই, ভুল করেও মূল কপির ফটোকপি নোটারি কিংবা বোর্ড, মিনিস্ট্রি এই সব জায়গায় সত্যায়িত করতে দৌড়াবেন না। মূলকপি সাথে থাকা মানেই এক সাথে দেখে যিনি দেখলেন তিনি নিজেই সত্যায়িত করে দিতে পারবেন। সেইটা এম্ব্যাসির লোক নিজেই হইতে পারে। সুতরাং, ভালোভাবে জেনে নিন সত্যি সত্যি ভেরিফিকেশন লাগবে কিনা। কেউ মাতবরি করতে চাইলে ভদ্র কিন্তু শক্ত ভাষায় চ্যালেঞ্জ করুন। কাগজ পত্র রেডি? এইবার তাহলে , পাঠানোর পালা।